ভারতের নানা রাজ্যে কাশ্মীরিদের হেনস্তা ও হুমকির অভিযোগ

প্রকাশিত: ১২:৫২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৭, ২০২৫

ডেস্ক রিপোর্ট:

 

ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার পর দেশের নানা স্থানে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ নাগরিকদের হেনস্তা ও হত্যার হুমকির অভিযোগ উঠেছে। এই অস্থিরতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বৈরিতা, যারা ভারতের অন্যান্য রাজ্যে পড়াশোনা করছেন। সামাজিক মাধ্যমেও কাশ্মীরিদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য ছড়ানো হচ্ছে।

কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রীদের সর্বভারতীয় একটি সংগঠন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, অনেক শিক্ষার্থী ভয়ে নিজ ঘরে আটকে রয়েছেন। একইসঙ্গে মুসলমান-বিরোধী ঘৃণাত্মক প্রচারও বেড়ে চলেছে সামাজিক ও গণমাধ্যমে। বিশ্লেষকদের মতে, পহেলগাম হামলার পর কেবল কাশ্মীরি ও মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার মানুষদের প্রতিও প্রবল মৌখিক আক্রমণ শুরু হয়েছে।

ভারত সরকার পহেলগামের হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানবিরোধী ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। নানা জায়গায় পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা চত্বরে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী ২৬টি পাকিস্তানি পতাকা পোড়ান। ত্রিপুরার আগরতলাতেও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পাকিস্তানের পতাকা পোড়ায়।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, রাস্তায় মানুষের চলাচলের পথে পাকিস্তানের পতাকা লাগানো হচ্ছে, যাতে মানুষ পতাকার উপর দিয়ে হাটে।

বিভিন্ন স্থানে কাশ্মীরি ছাত্রদের হুমকি ও হামলার অভিযোগ

উত্তরাখণ্ডের দেরাদুনে এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে একটি হিন্দু সংগঠনের নেতা দাবি করেন, প্রকাশ্যে কাশ্মীরিদের শহর ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন। কাশ্মীরি ছাত্রদের প্রতি হুমকি ছড়ানো এই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় আহ্বায়ক নাসির খুয়েমি জানিয়েছেন, পুলিশ কিছু হুমকিদাতাকে আটক করেছে, তবে হেনস্তার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।

তিনি বলেন, সারা দেশ থেকে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রীদের হেনস্তা ও হুমকির খবর আসছে। দেরাদুন, চণ্ডীগড় ও প্রয়াগরাজসহ নানা স্থানে মারধর, হুমকি এবং হয়রানির অন্তত আটটি বড় ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার কথা প্রকাশ না করতে প্রশাসনিক চাপ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

নাসির খুয়েমি জানিয়েছেন, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক আলোচনায় না জড়াতে এবং বেশি বাইরে বের না হতে।

পহেলগাম হামলার পর কাশ্মীরে প্রতিবাদ

পহেলগামে হামলায় নিহত ২৬ জনের মধ্যে একজন কাশ্মীরি মুসলিমও ছিলেন, যিনি পর্যটকদের ঘোড়ায় ভ্রমণ করাতেন। তিনি হামলাকারীদের কাছ থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিতে গিয়ে প্রাণ হারান।

হামলার পর কাশ্মীরের ট্যাক্সিচালকরা মোমবাতি মিছিল করেন এবং পরদিন পুরো কাশ্মীরে হরতাল পালিত হয়। স্থানীয় পর্যটন শিল্পও হামলার ঘটনায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পহেলগামের হামলার বিরুদ্ধে শ্রীনগরে কাশ্মীরীদের প্রতিবাদ। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীরি ছাত্রনেতা নাসির খুয়েমির মতে, সাধারণ কাশ্মীরিদের উপর হামলা, পর্যটন শিল্পের ক্ষতি এবং ভারতের সমাজকে বিভক্ত করাই ‘পড়শি দেশের’ মূল লক্ষ্য ছিল।

এদিকে, হামলার দুদিন পর ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গুলির ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের ঝন্টু আলি শেখ নামে এক মুসলিম সেনা নিহত হন।

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী কাশ্মীরে আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রীদের হেনস্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সমাজকে বিভক্ত করার জন্যই এ ধরনের হামলা করা হচ্ছে। এ সময় সকল ভারতীয়ের একত্রিত হওয়া জরুরি।’

ভুয়া অভিযোগের বিষয়েও সতর্কতা

পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেন, কলকাতার কাছাকাছি এলাকায় দুজন কাশ্মীরি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন এবং উন্নতমানের যোগাযোগ যন্ত্র বসিয়েছেন। তবে রাজ্য পুলিশের তদন্তে জানা যায়, ওই দুই ব্যক্তি কাশ্মীরি নন, একজন হিন্দু ও একজন মুসলিম এবং তারা মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা। তারা ব্যবসার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন এবং ছাদে বসানো যন্ত্রটি হাই-স্পিড ব্রডব্যান্ডের অ্যান্টেনা।

পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে সারা ভারতেই। ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ সাধারণ মানুষকে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার আগে স্থানীয় থানায় তথ্য জানানোর অনুরোধ জানিয়েছে। উল্লেখ্য, পহেলগাম হামলার পর একাধিক ভুয়া পোস্ট ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে অন্তত তিনটি অল্ট নিউজ শনাক্ত করেছে।

মুসলমান ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও নিশানায়

পহেলগাম হামলার সময় হামলাকারীরা পর্যটকদের ধর্মীয় পরিচয় জানতে চেয়েছিল এবং বেশিরভাগ নিহতই ছিলেন হিন্দু। এরপর মুসলমান বিদ্বেষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ভারতের সব মুসলিম ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতারা হামলার নিন্দা করেছেন এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছেন, বিদ্বেষ থামেনি।

গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, এবার সাধারণ মানুষের ওপর হামলা হওয়ায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেশি ছড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘পুলওয়ামায় সেনাদের ওপর হামলা হয়েছিল বলে রাগটা ছিল পাকিস্তানের ওপর। কিন্তু এবার যেহেতু সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, তাই পুরো মুসলিম সমাজের ওপরই ক্ষোভ বিস্তৃত হয়েছে।’

এবার মুসলমানদের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদেরও আক্রমণের শিকার হতে দেখা যাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী প্রচারযন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ বা ‘সেকুলার’ মানুষদের ‘সেকু-মাকু’ বলে কটাক্ষ করছে।

একজন হিন্দুত্ববাদী ইউটিউবার পিনাকপাণি ঘোষ দাবি করেন, ‘সেকু’রা সুবিধাবাদী এবং প্রকৃতপক্ষে তারা হিন্দু হয়েও হিন্দুত্বকে অস্বীকার করেন। স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এত প্রবলভাবে ধর্মনিরপেক্ষদের বিরুদ্ধে আক্রমণ অতীতে দেখা যায়নি। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর পাশাপাশি এবার ধর্মনিরপেক্ষদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।