ডেস্ক রিপোর্ট:
ইরানের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলের হামলা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পরিস্থিতির সূচনা ঘটিয়েছে। সেই সঙ্গে তেহরান ও তেল আবিবের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা দ্বন্দ্বেও এক ভয়ানক মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতত মনে হচ্ছে, দু’পক্ষ একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পেরেছে। কারণ, তাৎক্ষণিকভাবে ইরান কোনো পাল্টা হামলা চালানোর হুঁশিয়ারি দেয়নি।
শনিবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। ভোরে ইরানের তিনটি সামরিক স্থাপনায় এ হামলা চালায় ইসরায়েল। পরে প্রথমবারের মতো তারা ইরানের মাটিতে হামলার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে। এর আগে ইরানে অনেক হত্যাকাণ্ড ও নাশকতার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা হলেও তারা কৌশলগত নীরবতা বজায় রাখে। সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া হত্যার শিকার হন। এর পেছনেও ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়। আশির দশকে ইরাক যুদ্ধের পর ইসরায়েলের হামলাটি ইরানে কোনো বিদেশি বাহিনী দ্বারা সংঘটিত বিরল ঘটনা।
ইসরায়েলের হামলার পরপরই ইরান পাল্টা হামলা চালানোর কোনো ঘোষণা দেয়নি, যা মধ্যপ্রাচ্যের দুই বড় সামরিক শক্তির মুখোমুখি নিয়ন্ত্রণহীন লড়াইয়ের শঙ্কা কমিয়েছে। বার্লিনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলি গেরানমায়েহ বলেন, বছরের পর বছর ধরে চলা ছায়াযুদ্ধ শেষ হয়ে সংঘাত এখন পুরোপুরি খোলামেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে, যদিও আপাতত একটি লড়াই ঠেকানো গেছে। তিনি বলেন, তেহরান সামরিক স্থাপনার বিরুদ্ধে এসব হামলা সহ্য করে ফেলতে পারে। তারা হয়তো এমন প্রতিশোধমূলক হামলা চালাবে না, যা ইসরায়েলের আবার পদক্ষেপে উদ্বুদ্ধ করবে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে আক্রমণ সীমিত করার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। চলতি মাসের শুরুতে ইসরায়েলে ইরান একঝাঁক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। জবাবে ইসরায়েল ইরানের সংবেদনশীল পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা এবং তেলক্ষেত্রে আঘাতের পরিকল্পনা নেয়। ইসরায়েলের কর্মকর্তারা জানান, শনিবার তাদের যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যাটারি, রাডার স্টেশন ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রসহ প্রায় ২০টি সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।
এ হামলার পর ইরানের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়েই ছিল। দেশটির বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ইরানের আকাশসীমা পুনরায় চালু করেছে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রচালিত সংবাদ সংস্থাগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের আক্রমণের তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি– এমনটাই দেখাতে চাচ্ছেন ইরানের নেতারা, যাতে পাল্টা হামলার জন্য অভ্যন্তরীণ প্রত্যাশা কম থাকে।
তেল আবিবভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের ইরানবিষয়ক ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞ ইয়োয়েল গুজানস্কি বলেন, এটি নতুন পর্যায়ের সূচনা; সংবেদনশীল ও অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি ঘটনা। তবে ইরান থেকে শোনা যাচ্ছে, ‘ওহ, এটা কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘ফলে দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত এ রাউন্ডটি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। আমরা ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলা দেখতে পাব না। যদি পাল্টা হামলা হয়, তবে তা হবে ছোট আকারে।’
তথাপি বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, উত্তেজনা হ্রাস পেলেও সাম্প্রতিক ঘটনা ইরান ও ইসরায়েলকে একটি নিয়ন্ত্রণহীন সংঘাতের দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। বছরের পর বছর ধরে দুটি পক্ষ গোপন লড়াইয়ে লিপ্ত। তারা একে অন্যের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে; অন্যের বিরোধীদের সমর্থন দিয়েছে; আক্রমণ করলেও তার দায় অস্বীকার করেছে। গত বছর গাজায় ইরানের মিত্র হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হলে সেই গোপন সংঘাত প্রকাশ্য সংঘর্ষে রূপ নেয়।
এর মধ্যেই কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, ইসরায়েল যদিও সীমিত হামলায় এবার ক্ষান্ত হয়েছে, এর মাধ্যমে তারা আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইরানে বড় হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে। নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে; বিশেষ করে ইসরায়েল ও ইরানের উত্তেজনায়।