নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
কাঠের বাটাম দিয়ে স্লিপার আটকে চালানো হচ্ছে ট্রেন। পুরো রেলসেতুর এমন কোনো স্লিপার নেই, যেটিতে বাটাম লাগানো হয়নি। পুরো সেতুর ২৭টি স্লিপারকে একে অপরের সঙ্গে ধরে আছে ১৯ টুকরো কাঠের বাটাম। এর মধ্যে রেলসেতুর উত্তরপাশে ১০টি এবং দক্ষিণপাশে ৯টি বাটাম ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেতুতে থাকা কাঠের স্লিপারগুলোর কোনো রেল পয়েন্টে ভাঙ্গা, কোনোটি মাঝ থেকে খুলে পড়েছে। এমন অবস্থার মধ্যেই সেতুটি দিয়ে চলাচল করছে রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো।
এই রেলসেতুটি রাজশাহী মহানগরীর বুধপাড়া গণির মোড় এলাকায় অবস্থিত। সেতুটির নম্বর ৫৮। পুরো সেতুজুড়ে কাঠের ২৭টি স্লিপার রয়েছে। তবে স্লিপার নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। পুরো সেতুর ৭ থেকে ১০টি স্লিপারের নাজুক অবস্থা। একবার ট্রেন গেলেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সরে আরেকটির সঙ্গে লেগে যায়। গতকাল শুক্রবার (২২ মার্চ) দিনভর ৫৮ নম্বর রেলসেতু পর্যবেক্ষণে বিষয়গুলো লক্ষ্য করা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, সেতুটি রেললাইন স্থাপনের সময় তৈরি করা হয়েছিল। বিভিন্ন সময় সেতুর কাঠের স্লিপারগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। কোনো কোনো সময় ট্রেন চলাচল করা লাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় মেরামতের কাজ করা হয়েছে। কখনো রেলসেতুর গার্ডার (যার ওপরে স্লিপার বসানো এবং স্লিপারের ওপরে রেললাইন বসানো) সংস্কারের কাজ করেছে কর্তৃপক্ষ।
দীর্ঘদিনের এই রেলসেতুটির গার্ডার নির্দিষ্ট স্থান থেকে সরে যাওয়ার কারণে কয়েক বছর আগে সেতুটি মেরামত করা হয়। ওই সময় গার্ডারের নিচের অংশে লোহা ঢালাই দেওয়া হয়। এছাড়া গার্ডার সরে যাওয়া রোধে সেতুর পিলারে লোহার রড পুঁতে গার্ডার নির্দিষ্ট স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর সেতুর গার্ডার না সরে গেলেও স্লিপারের বেহাল দশায় বাড়াচ্ছে ট্রেন চলাচলে ঝুঁকি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেতুর কাঠের স্লিপারগুলোর কোনোটির বিভিন্ন অংশে ভেঙে গেছে, কোনোটির খসে পড়েছে। এমন অবস্থায় রেলওয়ের কর্মীরা সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন কাজ করেও স্লিপারগুলো ঠিক মতো রাখতে পারছেন না। ফলে নির্দিষ্ট জায়গায় স্লিপার রাখতে কাঠের বাটাম আশ্রয় নিয়েছেন তারা। ফলে পুরো সেতুর স্লিপার কাঠের বাতা দিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। পুরো কাজে কয়েকটি কাঠের বাতা ব্যবহার হলেও তা ভেঙ্গে গিয়ে ১৯ টুকরো হয়েছে। আর কাঠের বাতাগুলোতে বিভিন্ন সময়ে এতো পরিমাণের পেরেক লাগানো হয়েছে- তাতে পেরেক লাগানোর জায়গাও নেই বললেই চলে। তবুও স্লিপার আটকানো যাচ্ছে না যথাযথ স্থানে।
লাইনের পশ্চিম পাশ থেকে সেতুটিতে উঠতে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়বে ভাঙা কাঠের স্লিপার। সেখানে কাঠ আটকানো লোহার পিন ভাঙা স্লিপারে পুরো ঢেকে আছে। কাঠের বাটাম লাগানো হয়েছে। তিন নম্বর স্লিপারের করুণ দশা। এই স্লিপারের কাঠ এমনভাবে ভেঙেছে ফুটো দিয়ে নিচের পানি দেখা যাচ্ছে। পুরো স্লিপারের বেশিরভাগ অংশ ভেঙে গেছে। এরপর আট নম্বর স্লিপারের (রেলের উত্তরপাশে পাশের অংশ) গার্ডারের সঙ্গে কাঠ আটকানো লোহার নাট-বল্টু নেই। রেলসেতুর দক্ষিণের ১০ নম্বর স্লিপারের নাজেহাল অবস্থা। এটিতে একটি লোহার পিন লাগানো রয়েছে লাইনের সঙ্গে। অপর পাশে কাঠ ভাঙার কারণে ফাঁকা রয়েছে। এমন অবস্থায় বেশ কয়েকটি স্লিপারের।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেতুর ওপরে একটি রেললাইনের সঙ্গে অপরটি জোড়া দেওয়ার যে পয়েন্ট সেটিতে নাট-বল্টু লাগানো আছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো বাঁধা হয়েছে নাইলনের দড়ি দিয়ে। দড়ি বেঁধে নিশ্চিত করা হয়েছে যাতে নাট থেকে বল্টু খুলে না পড়ে যায়। তবুও রাখা যায় না নাটের সঙ্গে বল্টুকে। তবে রেলওয়ের অন্য কোথায় ব্যবহার হয়েছে এমন বেশ কিছু কাঠ লাগানো হয়েছে এই ব্রিজে। স্লিপারের গায়ে তার চিহ্ন রয়েছে। যা দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, ব্রিজের ওপরে কোনো ট্রেন উঠলে বিকট শব্দ হয়। যদিও এই শব্দ দুই-তিন বছর আগে তেমন হতো না। কিন্তু এখন ট্রেন গেলে বিকট শব্দ শোনা যায়। আবার সেতুর ওপরে ব্যবহার করা স্লিপারগুলো ট্রেন যাওয়ার পরে একটি আরেকটির সঙ্গে লেগে যায়। ফলে এমনিতেও সেতু পার হওয়া কষ্টকর হয়ে যায় সাধারণ মানুষের। দুর্ঘটনা এড়াতে রেলওয়ে সেতুটি দ্রুত সংস্কারের দাবি জানান তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের ওই এলাকায় কাজ করা কয়েকজন মিস্ত্রি বলেন, তারা কর্তৃপক্ষকে বার বার জানিয়েছেন ব্রিজটি সংস্কারের জন্য। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন এই সেতুতে সময় দিতে হয় তাদের। তার পরেও স্লিপারগুলো ঠিক থাকে না। ব্রিজের জন্য ১০টি কাঠের স্লিপারের জন্যও বলা হয়েছে। দ্রুত কাজ শুরু হবে।
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী (পথ) ভবেশ চন্দ রাজবংশী বলেন, সেখানে প্রতিদিনই লোকজন গিয়ে কাজ করছে। কাঠের স্লিপারগুলো সরে যায়। সেগুলো কাঠের বাটাম লাগিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা হয়। এই বাটামে কিন্তু কোনো লোড বহন করে না। তবে স্লিপারগুলো যেন সরে না যায় সেই জন্য ব্যবহার করা হয়।
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, সবগুলো সেতু খুঁটে খুঁটে দেখা হচ্ছে। ঈদের আগে আমরা সবগুলো সেতু আপডেট করব। আর ৫৮ নম্বর সেতুর কী সমস্যা সেটি আমরা ইঞ্জিনিয়ার পাঠিয়ে দেখব। না দেখে বলা যাবে না সেতুর কী অবস্থা।