রোজা রেখেও ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অনুভূতি এড়াবেন যেভাবে

প্রকাশিত: ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১১, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

রমজান মাসে বিশ্বজুড়ে রোজা পালন করছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ এই রোজা। এই মাস জুড়ে মুসলমানরা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

এই দীর্ঘ সময় খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকার কিছু স্বাস্থ্যগত সুবিধা থাকলেও, কেউ কেউ এই মাসে তাদের খাদ্যাভ্যাসের আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা বোধ করতে পারে। অথবা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময়ের জন্য খাদ্য ও পানীয় পরিহার করার ফলে অনেকেই এক ধরনের ক্লান্তি এবং অবসাদ অনুভব করতে পারেন। আবার যারা উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড সুগারের মতো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন তাদের এই উপবাস কষ্টকর হতে পারে।

এখানে স্বাস্থ্যকর উপায়ে রোজা রাখার জন্য পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের দেওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

বিবিসি অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেছে। যার মাধ্যমে অনেকেই রমজান মাসে কীভাবে কাটাবেন তার পরিকল্পনা করতে পারেন।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এমন কিছু কার্যকর পদ্ধতির কথা এখানে বলা হবে যা অনুসরণ করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

তিন ধাপে সেহরি

রোজাদার ব্যক্তি দিনের প্রথম আহার হল সেহরি। এই সময়ে তিনি যা খাবেন তা নির্ধারণ করবে যে তিনি সারাদিন রোজা রাখার সময় কতোটা ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত বা ক্ষুধার্ত বোধ করবেন।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ফাদি আব্বাস পরামর্শ দিয়েছেন যে নিম্নলিখিত টিপস অনুসরণ করলে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা সহজ হবে, শরীরে পানিশূন্যতা কম হবে যা স্বাস্থ্য ঠিক রাখবে।

আব্বাস বলেছেন, সেহরিতে আপনার উচিত এমন সব খাবারের দিকে মনোনিবেশ করা যাতে প্রায় ৭০ শতাংশ পানি থাকে।

তার মতে, খাবারটি তিন ধাপে খাওয়া উচিত এবং এক ধাপের সঙ্গে আরেক ধাপের যেন পাঁচ মিনিটের ব্যবধান থাকে।সেহরি শুরু করতে হবে সালাদ দিয়ে। এতে থাকতে পারে শসা, লেটুস ইত্যাদি। তবে খেয়াল রাখতে হবে সালাদে যেন লবণ বেশি না থাকে।

কেননা লবণ বেশি খেলে কয়েক ঘণ্টা পরে শরীরে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। পনির এবং বাদামের অনেক উপকারিতা থাকলেও এতে থাকা লবণের কারণে শরীরে পানির চাহিদা বেড়ে যায়।

তিনি বলছেন, সেহরির দ্বিতীয় ধাপে ক্ষেত্রে হবে শর্করা ও চিনি জাতীয় খাবার। এক্ষেত্রে দুই তিন টুকরো বা এক কাপ তাজা ফল খাওয়া ভাল, যেগুলোয় পানির পরিমাণ বেশি। যেমন তরমুজ, কমলা। চাইলে এসব ফলের জুস করেও খেতে পারেন এক কাপ পরিমাণে। এরপর তৃতীয় বা শেষ ধাপে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেতে হবে।

রোজা রাখার সময় সেহরিতে চা এবং কফি পান করা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। কারণ এসব পানি হল মূত্রবর্ধক এবং এতে ক্যাফিন থাকে। এতে শরীর থেকে দ্রুত পানি বেরিয়ে যাবে।

শরীরের তরল কমে যাওয়া মানে তা দ্রুত প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। না হলে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন হবে। এর ফলে মাথাব্যথা, নিম্ন রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ক্লান্ত বা অলস বোধ করলে কী করবেন?

রমজানের টেবিলে খাবারের সমাহার কেমন হবে সেটি একেকটি পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতির উপরও নির্ভর করে। আবার রোজার মাসে অনেকে আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইফতার বিনিময় করেন।

এই অভ্যাসের ফলে প্রতিদিন পরিবেশন করা খাবারের বহুগুণ দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং এইভাবে প্রত্যেকে বিভিন্ন রকম খাবার উপভোগ করতে পারেন। প্রতিদিন তাদের টেবিলে হরেক রকম খাবার থাকে।

এতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি ইফতারে তার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খায়। এতে তার কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা তিনি বুঝতে পারেন না।

এই ভুড়িভোজের ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, যেমন পেটে ব্যথা, পেট ভার লাগা, অলসতা, ঘুম ঘুম ভাব ইত্যাদি হয়।

তবে, কিছু মানুষের জন্য সমস্যাটি আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে যদি তার উচ্চ রক্তচাপ বা রক্তে চিনির মাত্রা বেশি থাকে।

ফাদি আব্বাসের মতে, রোজার প্রথম দিনগুলি সবচেয়ে কঠিন, কারণ শক্তির উৎস হিসাবে শরীরের চর্বির প্রয়োজন শুরু হয় চার দিনের পর থেকে।

আব্বাস বলেন, সেহরির মতো ইফতারও তিনটি পর্যায়ে খেতে হবে, এক খাবার থেকে পরের খাবারের মধ্যে ছয় মিনিটের ব্যবধানে থাকতে হবে।

কারণ, আপনার পেট ভরেছে কিনা মস্তিষ্কের সেই সংকেত পেতে ১৮ মিনিট সময় লাগে। তাই এই সময়ের কথা মাথায় রেখেই খাবারের ধাপগুলো সাজানো প্রয়োজন।

ফাদি আব্বাস ভাষ্য, প্রথম পর্যায়ে এক কাপ পানি খেয়ে রোজা ভাঙার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই পানি খেতে হবে বসে থাকা অবস্থায় এবং তিনটি ধাপেই পানি যোগ করতে হবে।

ছয় মিনিট পর, দ্বিতীয় ধাপে আপনি রোজার সময় শরীরের যে শক্তি হারিয়েছেন তা পূরণ করবেন। এজন্য চিনি ও শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া শুরু করেন। সেটা হাতে তৈরি খাবারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক খাবার হলে ভালো যেমন খেজুর বা তাজা ফলের রস।

তৃতীয় ধাপ শুরুর আগে আরও ছয় মিনিট অপেক্ষা করার কথা জানান ফাদি আব্বাস। পেটে চাপ না দেওয়ার জন্য একটি থালায় ছোট ছোট করে কাটা সালাদ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। শাকসবজিতে থাকা ফাইবার শরীরকে ভিটামিন সরবরাহ করতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে খুব প্রয়োজনীয়।

তিনি আরও বলেন, সালাদের পরে, আপনার খুব বেশি হলে একটি বা দুটি খাবার খাওয়া উচিত, যাতে প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আলু, ভাত, রুটি, পিঠা, খিচুরি ইত্যাদি।

শুধুমাত্র এক ধরনের খাবারই বেছে নেবেন। একইভাবে প্রোটিনের ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র এক ধরনের খাবার খাবেন যেমন: বিভিন্ন ধরনের শস্য, ডিম, চর্বিহীন মাংস, এবং দুগ্ধজাত খাবার।

এসব খাবার কতোটা চিবিয়ে খাচ্ছেন সেটাও জরুরি। খাবার নরম হলে ৩০ সেকেন্ড ধরে চাবাবেন এবং শক্ত হলে যেমন যেমন মাংস এবং বাদাম এগুলো খেতে এক মিনিট ধরে চিবিয়ে খাবেন।

শরীরের জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও, একবারে অনেক পানি খাওয়া এবং ভুল উপায়ে প্রচুর পরিমাণে পান করা অন্ত্র এবং কিডনির কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

অতএব, আপনাকে অবশ্যই একটি স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং সকালের নাস্তা খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে একবারে দুই কাপের বেশি পানি পান করবেন না।

তবে পানি খাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার তৃষ্ণার্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত নয়, বরং প্রতি ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা পর পর আপনার পানি পান করা উচিত। এমনকি পানি পান করার সময় মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনি অ্যালার্ম সেট করতে পারেন।