করোনাভাইরাসের কারণে ১৮ এপ্রিল বসেছিল সংসদের ইতিহাসের ক্ষুদ্রতম অধিবেশন। সংসদ সদস্যরা এসেছিলেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে। (ছবি: ফোকাস বাংলা)
সংসদ অধিবেশনে এমপিদের রোস্টারভিত্তিক যোগ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদেরও করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা হবে। সংসদে যোগ দেওয়া এমপিদেরও গণহারে কোভিড-১৯ পরীক্ষার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। অধিবেশনে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করা হবে বয়স্ক ও অসুস্থ সংসদ সদস্যদের। সংসদ সদস্য উপস্থিতির ক্ষেত্রে কেবল কোরাম পূর্ণ হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অধিবেশন সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য কাউকে সংসদ ভবনে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে না। অধিবেশন হবে যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত। গণমাধ্যমকর্মীদেরও সুযোগ দেওয়া হবে না সরাসরি সংসদে প্রবেশ করে সংবাদ সংগ্রহের। অধিবেশন চলাকালে সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা পালন করা হবে যথাযথভাবে।
এমন পরিকল্পনা নিয়ে আগামী ১০ জুন শুরু হতে যাওয়া জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রস্তুতি শুরু করছে জাতীয় সংসদ। সংসদ সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, বাজেট অধিবেশনের সার্বিক প্রস্তুতি বিষয়ে সোমবার বৈঠকে বসবে সংসদ সচিবালয়। সংসদের হুইপরাও আজকালের মধ্যে পৃথক বৈঠক করে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করবেন।
সচরাচর বাজেট অধিবেশন দীর্ঘ হলেও এবারের অধিবেশন হবে সংক্ষিপ্ত। ১০ জুন শুরু হওয়া এ অধিবেশন ৩০ জুন বাজেট পাসের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। ১১ জুন বাজেট পেশের পর মধ্যে মধ্যে বিরতি দিয়ে চলবে সংসদের বৈঠক। সব মিলিয়ে এবারের বৈঠক সাত থেকে আট কার্যদিবসের মতো চলতে পারে বলে জানা গেছে।
সংসদ অধিবেশন আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন এমন সূত্রে জানা গেছে, বাজেটের ওপর আলোচনাও হবে সংক্ষিপ্ত। সম্পূরক বাজেটসহ সব মিলিয়ে ১০/১২ ঘণ্টা আলোচনা হতে পারে। সাধারণত অধিবেশন শুরুর দিন সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সার্বিক বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলেও কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক এবার হচ্ছে না। কমিটির প্রধান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং কমিটির সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সংসদের কার্যক্রম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানা গেছে, ১১ জুন বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদে আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। এরপর যেসব দিনে সংসদের কাজ চলবে সেসব দিনে অধিবেশন শুরু হবে বেলা ১১টায়। একবেলার মধ্যেই দিনের কার্যসূচি শেষ করা হবে। অধিবেশনে বাজেটের ওপর আলোচনা ছাড়া অন্য কোনও কার্যক্রম থাকছে না। থাকছে না প্রশ্ন-উত্তরও।
প্রতিবছর বাজেট উপস্থাপন সরাসরি দেখার জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, বিদেশি মিশনের প্রতিনিধি, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ এবং সম্পাদকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে। তবে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে এবার কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। গণমাধ্যমকর্মীদের সংসদে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে। তাদেরকে সংসদ টেলিভিশন ও সোশ্যাল মাধ্যমসহ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদ সংগ্রহের পরামর্শ দেওয়া হবে। এবার সাংবাদিকদের বাজেট ডক্যুমেন্ট সংসদ সচিবালয়ের গণসংযোগ দফতরের পরিবর্তে মিডিয়া সেন্টারে বসে সংগ্রহ করা হতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংসদ সদস্যদের উপস্থিতির বিষয়ে কেবল কোরাম পূর্ণ (৬০ জন) হওয়ার বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংসদ কক্ষে এমপিদের বসার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংসদ কম-বেশি ৮০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে উপস্থিতি সীমাবদ্ধ রাখা হবে। অবশ্য ১১ জুন বাজেট অধিবেশনের দিনে এক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় থাকতে পারে। এক্ষেত্রে হুইপরা বসে রোস্টার করে সেই অনুযায়ী এমপিদের উপস্থিত হতে অনুরোধ জানাবেন। বাজেট আলোচনায় তালিকা অনুযায়ী যেদিন যারা অংশ নেবেন তারাসহ পূর্ব নির্ধারিত সংসদ সদস্যদের নির্দিষ্ট দিনে আসতে বলা হবে। বাজেট আলোচনায়ও হাতেগোনা কয়েকজন সদস্যকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে। মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও যার যেদিন কার্যক্রম থাকবে তিনি বাদে অন্যদের আসতে নিরুৎসাহিত করা হবে। সেদিন বাদে অন্য সময় আসতে নিরুৎসাহিত করা হবে। এছাড়া বয়স্ক পুরুষ ও নারী সংসদ সদস্যদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করা হবে।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রী-এমপিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতির বিষয়ে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি ও সতর্কতা থাকবে। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত এক ঘণ্টার বৈঠকে যেসব স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়েছিল তার সবই করা হবে বাজেট অধিবেশনে। এর বাড়তি হিসেবে সংসদে প্রবেশের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের করোনা টেস্ট বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে এটি এখনও চূড়ান্ত নয়।
সংসদ সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও একাধিক হুইপ জানান, অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের যোগদানের ব্যাপারে রোস্টার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রোস্টারের ভিত্তিতে এমপিরা তাদের জন্য নির্ধারিত বৈঠকগুলোতে যোগদান করবেন। প্রতিদিনের রোস্টারে ওইদিন বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নেওয়া এমপিরাও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। প্রতিদিন উপস্থিতি ৬০ থেকে ৮০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এর আগে লকডাউনের মধ্যে সংবিধানের নিয়ম রক্ষায় একদিনের জন্য সংসদ অধিবেশন হয়। ১৮ এপ্রিলের ওই অধিবেশনে ৩৫০ এমপির মধ্যে ১৩৫ জন অংশ নিয়েছিলেন। বাজেট অধিবেশনে এই উপস্থিতির সংখ্যা আরও কম করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, রোস্টার করে যতজন এমপি আনা দরকার, ততজনকে আনা হবে। সীমিত সময়ের জন্য বাজেট পাসের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে এগুলো করা হবে। সবাইকে না করা হলেও কর্মচারীদের মধ্যে যারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি যাবেন, তাদের করোনা টেস্ট করানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের টিভি দেখে সংসদ কভার করতে হবে।
তিনি বলেন, সংসদ অধিবেশনের জন্য আমরা সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নেবো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যেসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তার সবই অনুসরণ করা হবে।
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির সংশ্লিষ্ট কর্মচারীসহ ভিভিআইপি এলাকায় যেসব কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন আগে থেকেই তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হবে। সংসদ কক্ষের ভেতর যেসব কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন তাদেরও পরীক্ষা করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংসদ সদস্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। কয়েকজন সংসদ সদস্যের কোভিড পজিটিভ পাওয়া গেছে। আরও কিছু সদস্য নিজেদের মতো করে পরীক্ষা করিয়েছেন। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সংসদ সদস্যদের পরীক্ষার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে যারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তাদের হয়তো পরীক্ষা করা হতে পারে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এসএসএফ এর পক্ষ থেকে সংসদ সচিবালয় ও সংসদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে সংসদ সচিবালয়ের কিছু আবশ্যকীয় কর্মচারীসহ একজনের করোনাভাইরাস পরীক্ষাসহ আরও কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। সংসদ সচিবালয় এসব প্রস্তাবনা প্রতিপালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
সংসদ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে তিনজন এমপি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তারা হলেন নওগাঁর শহীদুজ্জামান সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এবাদুল করিম বুলবুল ও চট্টগ্রামের এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। তারা তিনজনই এখন সুস্থ। এছাড়া সাবেক চিফ হুইপ আবদুস শহীদের পিএসসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও আক্রান্ত। এর বাইরেও অনেকের করোনা উপসর্গ রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে মন্ত্রী-এমপিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রবেশে করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে যার যেদিন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কার্যক্রম থাকবে, তার সেদিন উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি অন্যদের সংসদে আসতে নিরুৎসাহিত করা হবে। তবে এ বিষয়ে হুইপরা স্পিকারের সঙ্গে আলাপ করে কৌশল নির্ধারণ করবেন। চিফ হুইপ সব হুইপকে নিয়ে বসবেন।
উল্লেখ্য, সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষায় মহামারির মধ্যে গত ১৮ এপ্রিল বসেছিল জাতীয় সংসদের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম অধিবেশন। ওইদিন মাস্ক, গ্লাভস পরে নিরাপদ দূরত্বে বসাসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা ধরনের বিধি-বিধান প্রয়োগ করা হয়।
সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন।