নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
গরমে স্তস্তি দেয় ঐতিহ্যের শীতলপাটি, যার নামের মধ্যেই নিহিত আছে শীতলতার পরশ। শীতলপাটি একধরনের মেঝেতে পাতা আসন বা গালিচা। এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যগত কুটিরশিল্প। শীতলপাটির চাহিদা একসময় দেশব্যাপী সমাদৃত থাকলেও, সময়ের ব্যবধানে এটি এখন বিলুপ্তির পথে। একসময় লোকশিল্পের মধ্যে অন্যতম ছিল পাটিশিল্প। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নানাবিধ পণ্যের ব্যবহারের ফলে শত বছরের এই পাটিশিল্প হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। বংশপরম্পরায় এই শিল্পের কিছু কারিগর টিকিয়ে রেখেছে শিল্পটিকে। বর্তমানে এই শিল্পের কাঁচামালের সংকট, পুঁজির অভাব এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হতাশায় পেশা বদল করছেন অনেক কারিগর। তবে পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে শীতলপাটিই হতে পারে এ দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শীতলপাটি তৈরি হয়। তবে সিলেট এলাকায় বিভিন্ন স্থানে যে মানের শীতলপাটি তৈরি হয়, তা সর্বোত্কৃষ্ট। সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় পাটিকররা তাদের নিপুণতার জন্য শত শত বছর ধরে প্রসিদ্ধ। প্রান্তিক এই শিল্পের স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি এখন ইউনেসকো-ঘোষিত। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেসকো ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
জানা যায়, পাবনা জেলার আটঘরিয়া গ্রামের শখানেক কারিগর শীতলপাটি তৈরির কাজ দল বেঁধে করে থাকেন। তবে নারীরাই এই শৈল্পিক বুননের কাজটি বেশি করে থাকেন। শীতলপাটি একই সঙ্গে কারুশিল্প ও লোকশিল্প। শহরে শোপিস এবং গ্রামে এটি মাদুর ও চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। সিলেটের পর সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলা, বরিশাল, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে মুর্তাগাছ জন্মে এবং সেই গাছ থেকে পাটি তৈরি হয়। রাজধানী ঢাকার নিউ মার্কেট, কাওরান বাজারে শীতলপাটি কিনতে পাওয়া যায়। এর দাম আকার অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়। তবে নকশা করা পাটিগুলোর দাম বেশি হয়ে থাকে।
১৯২০-এর দশকে প্রকাশিত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ নামীয় গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে শীতলপাটি সম্পর্কে জানা যায়—‘মূর্তা নামক এক ধরনের গুল্মের বেত্র দ্বারা শীতল পাটি প্রস্তুত হয়। ইহা শীতল, মসৃণ ও আরামদায়ক বলিয়া সর্বত্র সমাদৃত। বঙ্গদেশের অন্য কোথাও এইরূপ উত্কৃষ্ট পাটি প্রস্তুত হইতে পারে না।’ আমাদের অহংকারের নাম শীতলপাটি। শৈল্পিক হাতের নিপুণ গাঁথুনিতে পূর্ণতা পায় একেকটি শীতলপাটি। নারী-পুরুষ উভয়ের যৌথ পরিশ্রমে তৈরি হয় এই পাটিশিল্প। তবে শৈল্পিক বুননের কাজটি করেন ঘরের নারীরা। আর এর কাঁচামাল সংগ্রহ ও বিপণনের কাজটি করে থাকেন পুরুষরা। গুণমান অনুযায়ী একেকটি শীতলপাটি ৮০০ টাকা থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। জেলা শহরের দোকান ছাড়াও ফড়িয়া ও আড়তদাররা পাইকারি দামে পাটি কিনে সরবরাহ করছেন রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামে। তবে দেশীয় এই শিল্পের কদর বিদেশেও রয়েছে সমানভাবে বলে জানান পাটিবিক্রেতা আশরাফ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে অনেক ক্রেতা পাটি কিনে বিদেশে পাঠান। সেই পাটি তারা সূক্ষ্মভাবে দেখে নেন, সেই পাটির গায়ে কোন ধরনের খুঁত থাকা যাবে না।’
শত বছরের ঐতিহ্য এই পাটিশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন গুটিকয়েক কারিগর। কাঁচামাল, পুঁজির অভাব এবং ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার হতাশায় অনেক কারিগরের উত্তরসূরিরা পেশা বদল করছেন। তবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমাদের অহংকারের নাম হবে শীতলপাটি—বলে জানান পাবনার পাটিকর স্বপন কুমার। ঝালকাঠির নলছিটি এলাকার শীতল পাটিও বিখ্যাত। অন্য একজন পাটিকর নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘আমাদের জীবন একভাবেই কেটে যাচ্ছে, কোনো পরিবর্তন নেই। এই কাজের কোনো মূল্য পাই না।’ তাদের ছেলে নিমাই চন্দ্র বলেন, ‘বাপ-দাদার এই কাজ আর আমরা করতে চাই না। এখন আমরা অন্য কাজ করতে চাই।’ নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘একটি পাটি তৈরি করতে ছয় থেকে আট দিন সময় লাগে।’ তবে নারীদের এই কাজে সময় একটু বেশি লাগে বলে জানান ইতি রানী। তিনি বলেন, ‘আমরা ঘরের কাজ শেষ করে পাটির কাজ করি, তাই সময় একটু বেশি লাগে।’
বর্তমানে প্লাস্টিক ও অন্যান্য পণ্যের দাপটে এবং ভূমির অভাবে শীতলপাটির কদর কমেছে। তবে এই শীতলপাটি দিয়ে তৈরি কলমদানি, ব্যাগ, টিস্যু বক্স, রানারসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে। এই শীতলপাটিই হতে পারে রপ্তানির অন্যতম পণ্য। ১৫ থেকে ২৯ বছর ব্যবহার করা যায় একেকটা শীতলপাটি। দেশীয় এই শিল্পের উপযুক্ত প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে ই-কমার্স সেক্টরেও সম্ভাবনার এই শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে পারে। তবে এই পাটিশিল্পের শিল্পী ও শিল্প রক্ষায় প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।