শেখ সেলিম কমিশন নিতেন ১০-১৫%

দুদকের তথ্য

প্রকাশিত: ৩:০৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০২৫

সেলিনা আক্তার:

 

প্রকল্পের দরপত্রে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়ে হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে পকেটে ভরেছেন শতকোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসসহ একাধিক স্থানে তাঁর সম্পদ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক ও মুখপাত্র মো. আক্তার হোসেন গতকাল এক ব্রিফিংয়ে এ সব তথ্য জানান।

দুদকের দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। পরে টানা চারবার গোপালগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) ছিলেন। ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। মন্ত্রিত্ব না থাকলেও শেখ পরিবারের পরিচয়ে সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করতেন। স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, সড়ক পরিবহনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারি কাজের বড় অংশ ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। বিশেষ করে বৃহত্তর ফরিদপুর, খুলনা, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের সব উন্নয়নমূলক কাজ ভাগবাটোয়ারা করতেন। বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিতেন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন। তাঁর অনুমতি ছাড়া এসব অঞ্চলে ঠিকাদারি কাজের অনুমতি দেওয়া সম্ভব ছিল না।

দুদক জানায়, কিছুদিন আগে পছন্দের ঠিকাদারদের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেন সেলিম। কার্যাদেশ দেওয়ার আগে তাদের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশনের টাকা পকেটে তুলেছেন। এরই মধ্যে দুদক তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দরপত্র-বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতির একটি অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। কমিশনের বিশেষ তদন্ত শাখা থেকে এটি অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার বনানীতে সেলিমের বাসায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় বিক্ষুব্ধ জনতা প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজের হিসাব পায়। ২৪ পৃষ্ঠার ওই নথিতে লেখা রয়েছে, কাকে কোন কাজ দেওয়া হবে এবং সেখান থেকে কমিশন বাবদ কত টাকা পাওয়া যাবে। জাতীয় সংসদের একটি প্যাডে সেলিম ও তাঁর পরিবারের বেশ কিছু ব্যাংক হিসাব নম্বর লেখা রয়েছে। তবে ওইসব হিসাবে লেনদেন বা জমা টাকার পরিমাণ উল্লেখ নেই। প্যাডের আরেক পৃষ্ঠায় পরিবারের কয়েকজন সদস্যের পাসপোর্ট-সংক্রান্ত তথ্য লেখা ছিল।
অভিযোগে বলা হয়, উদ্ধার হওয়া নথিতে গোপালগঞ্জের ১১টি, খুলনার তিনটি, রাজশাহীর দুটি এবং চুয়াডাঙ্গা, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও নাটোরের একটি করে প্যাকেজের দরপত্রের বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সড়ক ও জনপথ, স্টেডিয়াম নির্মাণ বা সংস্কার, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উন্নয়ন কাজে তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল।

ওই নথিতে দরপত্র দাখিলের তথ্য, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম, টাকার পরিমাণ, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামের পাশে টিক, প্রতিটি প্যাকেজের নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম লিখে পাশে বসানো হয়েছে টাকার অঙ্ক। কয়েকটি প্যাকেজে রেফারেন্স হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম লেখা রয়েছে। গোপালগঞ্জ-১ প্যাকেজে সুইমিং পুল নির্মাণকাজের তথ্য রয়েছে। সেখানে বিএফএল/এইচএলসি-জে/ভি নামে ১২ কোটি ২৩ লাখ ৯৯ হাজার, কিউ এইচ মাসুদ অ্যান্ড কোম্পানির নামে ১১ কোটি ৬০ লাখ ৩৯ হাজার, মেসার্স আনাম ট্রেডার্সের নামে ১০ কোটি ২২ লাখ ৫৬ হাজার, এ এস-এ এটকো-জে/ভি নামে ৯ কোটি ৩৪ লাখ ৫৯ হাজার টাকার উল্লেখ আছে। নোটে সানু, এনাম ও ইউসুফ নামের পাশে ৮ লাখ টাকা লেখা রয়েছে।

গোপালগঞ্জ প্যাকেজ-২-এ প্যাভিলিয়ন বিল্ডিং গ্যালারি নির্মাণে মার্কেন্টাইল করপোরেশনের পাশে ১১ কোটি ৬৭ লাখ ৬৩ হাজার, বিএফএল-এএলসিএল জে/ডি নামে ১৩ কোটি ৮৯ লাখ ২০ হাজার, কিউ এইচ মাসুদ অ্যান্ড কোম্পানির নামে ১৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭৮ হাজার, মেসার্স আনাম ট্রেডার্সের নামে ১১ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার টাকার উল্লেখ আছে। মার্কেন্টাইলের পাশে মাহবুব উল্লেখ রয়েছে। নিচে পান্না-শিবু নামের পাশে ৫ লাখ লেখা আছে। শেখ সেলিমের ওই নথিতে গোপালগঞ্জের বাইরে চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও নাটোরের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ ভাগবাটোয়ারার প্রমাণ মিলেছে। শেখ সেলিমের হাতে লেখা নথিতে ফরিদপুর জেলা স্টেডিয়াম নির্মাণকাজের জন্য ১৩ ঠিকাদারের তালিকা রয়েছে। রাজশাহীতে উইমেন স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণের ঠিকাদারি তথ্য রয়েছে। সেখানে ২০ প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। আরেকটি প্যাকেজে এ কমপ্লেক্সের সুইমিং পুল নির্মাণকাজের জন্যও ২০ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রস্তাবের তথ্য পাওয়া গেছে।

সরকারি কাজের নিয়ম অনুযায়ী, দর প্রস্তাবের তথ্য গোপন থাকে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাইরে অন্য কারও এটি জানার কথা নয়। কিন্তু সেলিমের নথিতে প্রতিটি উন্নয়নকাজের জন্য দর প্রস্তাব জমা দেওয়া ঠিকাদারদের আর্থিক প্রস্তাবের বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। দরপত্রের বিস্তারিত তথ্য সেলিম পেয়ে যেতেন। পরে প্রভাব খাটিয়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। গোপন নথিতে গোপালগঞ্জের ১১টি উন্নয়নকাজ ১১ প্যাকেজে ভাগ করে ঠিকাদার নির্ধারণ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব প্যাকেজে সীমানা দেয়াল, বিদ্যুতের সাব স্টেশন, গ্যালারি শেড, স্টেডিয়াম সংস্কার ও উন্নয়ন, হোস্টেল কাম অফিস ভবন, উইমেন স্পোর্টস কমপ্লেক্সে জিমনেশিয়াম, স্টেডিয়াম ও স্পোর্টস কমপ্লেক্সে গ্যালারি চেয়ার স্থাপনসহ নানা নির্মাণকাজের তথ্য রয়েছে।