সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব : প্রশাসন ক্যাডারের তরুণদের ক্ষোভ

প্রকাশিত: ৩:৫২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক:

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারের কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করে সুপারিশ চূড়ান্ত হয়েছে- এমন খবর সংবাদপত্রে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের তরুণ কর্মকর্তারা।

মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ৩০ থেকে ৪১তম ব্যাচের একাধিক তরুণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র দেখা গেছে।

এদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাব নিয়ে এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে প্রশাসন ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তারা জড়ো হয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করেন। এসময় আয়োজিত এক জরুরি মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রশাসন ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং এই সিদ্ধান্ত তাদের প্রতি ভয়াবহ অবিচার বলে বক্তব্য তুলে ধরেন।

৩০ থেকে ৪১তম ব্যাচের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবেই উপসচিব পদে মূলত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই কাজ করে থাকেন। এ বিষয়ে করা রিট মামলায় উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই শেষে আপিল বিভাগ ২৪ মে ২০১০ সালে চূড়ান্ত আদেশে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৭৫ শতাংশ নিয়োগ প্রদান বৈধ ঘোষণা করেন।

প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তারা মনে করে, আদালতের রায় উপেক্ষা করে এ ধরনের সুপারিশের প্রস্তাব একদিকে আদালত অবমাননার শামিল অপরদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করার শামিল। পাশাপাশি এই সুপারিশ নবীন কর্মকর্তাদের জন্য বৈষম্যমূলক। এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে এবং রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা দুর্বল হতে পারে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তারা।

আয়োজিত ওই জরুরি মত বিনিময় সভায় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩০ ব্যাচ থেকে ৪১ ব্যাচের প্রতিনিধিরা বক্তব্য প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীসহ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য প্রদান করেন।

এসময় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নেতারা তাদের বক্তব্য সরকারের উচ্চ মহলে তুলে ধরার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে, রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া ও কার্যক্রম গ্রহণের আশ্বাস দেন।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সরকারের নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ‘কোর’ অফিসগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করেন। এই সুপারিশের ফলে প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যাবে। ফলে, এক বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তার ক্যারিয়ার অনিশ্চিত হয়ে পড়বে যা প্রভাব ফেলবে প্রশাসনের ‘ইস্পিরিট ডি কর্পস’ বা মনোবলে। প্রশাসন যেহেতু সরকারের নানা নীতি বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে সেহেতু মনোবলহীন প্রশাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার নামান্তর হবে।

নবীন কর্মকর্তারা আরও মনে করেন, সরকারের নীতি বাস্তবায়নে তারা প্রায় ২৪/৭ মাঠে কাজ করে থাকে। ৫ আগস্টের পর যখন রাজনীতিবিদেরা মাঠে অনুপস্থিত ছিল। পুলিশ অকার্যকর ছিল তখন স্থানীয় সরকারের নানা পর্যায়ে যেমন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ইত্যাদি নানা পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারকে কার্যকর রেখেছে। এই সুপারিশের ফলে ক্যারিয়ারে পদসোপান যদি কমে যায় তবে তারা বাড়তি কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এতে করে মাঠ প্রশাসনের কার্যকারিতা অনেকাংশেই কমে যাবে এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ভেঙে যাবে। ফলে, সরকারের নীতি বাস্তবায়নে নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে যার প্রভাবে রাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নে সক্ষমতা কমে যাবে। সরকারের এই সময়ে যা হতে পারে সরকারের জন্য বিপজ্জনক।

নবীন কর্মকর্তাদের মধ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, উপসিচব পদটি প্রশাসন ক্যাডারের সহজাত পদ বলে রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ। সেটি উপেক্ষা করে এই অন্যায্য সুপারিশ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বৈষম্যমূলক। যেখানে অন্য সব ক্যাডার কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতির দুটি সুযোগ পাচ্ছে। ১. নিজের ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতির সুযোগ। ২. উপসচিব পদে পদোন্নতির সুযোগ সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা একটি সুযোগ পাচ্ছেন একটি-উপসচিব পদে পদোন্নতির সুযোগ।

আরেক কর্মকর্তা বলেন, কমিশনের এই সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে জুনিয়র কর্মকর্তারা যারা এখনো উপসচিব পদে পদোন্নতি পায়নি। এসব কর্মকর্তারা বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সময় উপসচিবে নিজেদের সুযোগ ৭৫ শতাংশ আছে ধরেই চয়েজ প্রদান করেছেন। ক্যারিয়ারের মাঝপথে এসে এই ধরনের পরিবর্তন ‘ডকট্রিন অফ লেজিটিমেট এক্সপেকটেশন’এর লঙ্ঘন।