নিজস্ব প্রতিবেদক:
ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই সতর্ক বিএনপি। সারাদেশে সংঘটিত নানা নৈরাজ্য, হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দখল, চাঁদাবাজির ঘটনা থেকে দলকে দূরে রাখতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন শীর্ষ নেতারা। একদিকে নৈরাজ্যকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স; অন্যদিকে সারাদেশে থানা-উপজেলা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রাতদিন বসিয়েছেন পাহারা। যারাই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হবেন, তাদের বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দলের নেতাকর্মীর বিষয়ে রয়েছে আরও সতর্কবার্তা। ন্যূনতম সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করেছে দলটি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসররা পরিকল্পিতভাবে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার, তথা বিজয়ী ছাত্র-জনতার ওপর প্রতিশোধের নীল-নকশা নিয়ে মাঠে নেমেছে। জনরোষে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নাগরিকদের সম্পদ ও ধর্মীয় উপাসনালয়কে বিশেষভাবে টার্গেট করেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লক্ষ্যে সমাজকে বিভক্ত করাই এ মুহূর্তে তাদের ষড়যন্ত্র। তবে তারা এ বিষয়ে সজাগ রয়েছেন। ইতোমধ্যে সাধ্যমতো সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। দলের নাম ব্যবহার করে কেউ যদি এ ধরনের অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে, তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগের ভিত্তিতে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শোকজ করা হয়েছে আরও বেশ কয়েকজনকে। কেন্দ্রের এ কঠোর বার্তা দলের তৃণমূলের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন নেতারা। নৈরাজ্য প্রতিহত করতে জনসচেতনতার উদ্দেশে এলাকায় এলাকায় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। এতে দুষ্কৃতকারীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। বেশ কিছু এলাকায় নেতাদের মোবাইল ফোন নম্বরসহ লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে।
দলের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘দলমত, ধর্ম-বর্ণ, পেশা-নির্বিশেষে যে কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো নিরাপদ রাখার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। নিজ নিজ পাড়া-মহল্লায় দলীয় নেতাকর্মী ও ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সব ধরনের নৈরাজ্য প্রতিহত করুন। কেউ দয়া করে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধে লিপ্ত হবেন না। কোনো পরাজিত শক্তি কিংবা কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করতে চাইলে, তাদের আইনের হাতে তুলে দিন। যদি কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চলছে নানা কর্মসূচি, সতর্ক দলের নেতাকর্মী
নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দলের কঠোর নির্দেশনার পর থেকে সারাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার সর্বাত্মক অপচেষ্টা রুখে দিতে কাজ করছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। রাজধানীর শ্রীশ্রী রমনা কালীমন্দির, জাতীয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, শাহবাগ জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক পাহারা বসিয়েছেন তারা। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারাদেশের একই চিত্র।
বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা জানান, সারাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি গুজব-গুঞ্জন সৃষ্টি করা হচ্ছে ছাত্র-জনতার বিজয়কে বিতর্কিত করার জন্য। আগের মতো বিএনপির বিরুদ্ধে এ দোষারোপ করে দেশ-বিদেশে সাম্প্রদায়িক দল বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর একই ধরনের কাজ করেছিল একটি মহল। সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখে এবার শুরু থেকেই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। তবুও ওই মহলটি একইভাবে মিথ্যা প্রচারণা শুরু করেছে। তারা একটি দেশের অনুকম্পা পেতে নানা নাটক তৈরি করছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের নানা গুজব সৃষ্টিতে তৎপরতা শুরু করেছে। তবে এবার আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার সরকার বিদায়ের পর বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল এবং রাজপথের শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকায় মন্দিরসহ সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন উপাসনালয়ে হামলা-অগ্নিসংযোগের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমনকি মাদ্রাসার ছাত্র, হুজুররাও এবার এসব স্থাপনায় রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। ফলে সেখানে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি সুযোগসন্ধানী ওই মহলটি।
তাৎক্ষণিক বহিষ্কার
দলের এমন কঠোর অবস্থানের মধ্যেও সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে। জমিজমা, হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ড, পুকুর দখল, প্রতিপক্ষের বাড়িঘর দখলের মতো গুরুতর কিছু অভিযোগও উঠেছে। তাদের শনাক্ত করে সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল রোববার বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে। জনগণের নামে লিখে দেওয়া ১০ কোটি টাকা মূল্যের পুকুর দখলের অভিযোগ ওঠে সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এই এমপির বিরুদ্ধে। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় তহবিলের অর্থ তছরুপসহ নানা অভিযোগ ছিল। ছাত্রদলের ও যুবদলের শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর বাইরে স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল এবং বিএনপিরও বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
গত শুক্রবার এক দিনেই যুবদলের ১৪ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া হিন্দু ব্যবসায়ীর বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় খুলনার পাইকগাছা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এস এম এনামুল হক ও সদস্য কিশোর মণ্ডলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ দলীয় পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের পাঁচ নেতাকর্মীকে শোকজ করা হয়েছে। যদিও এসব বহিষ্কারের মধ্যেও অনেক শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে জানা গেছে। এলাকায় কোন্দলের কারণে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে শুরু করেছে অপবাদের রাজনীতি। এতে তৃণমূলেও চলছে আতঙ্ক।
বেকায়দায় আওয়ামী লীগসমর্থিত সংখ্যালঘু নিয়ে
বরিশালের গৌরনদী এলাকার কাওসার হোসেন নামে বিএনপির এক নেতা সমকালকে জানান, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে অনেক হিন্দু পরিবার আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিল। ছিল ওই দলের বিভিন্ন কমিটিতে। বিগত দিনে তারা এলাকায় অনেককে নির্যাতনও করেছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্যাতিত অনেক সংখ্যালঘু সদস্যই তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। আর এটাকেও বিএনপির নির্যাতন হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করছেন আওয়ামী ওই সব নেতা। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে নির্যাতিত নেতাকর্মীকে সতর্ক করা হয়েছে, তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
একই রকম পিরোজপুর, খুলনা, মাদারীপুর, শরীয়তপুরের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় দিনরাত কাজ করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশে নানা অপকর্ম করছে। বিভিন্ন জায়গায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ধরাও পড়ছেন। তবে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফেরাতে বিএনপির পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
অঙ্গসংগঠনের বাইরে বিএনপি নেতারাও রয়েছেন কঠোর অবস্থানে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু বলেন, আমরা নৈরাজ্য বন্ধ করতে জিরো টলারেন্স ভূমিকা নিয়েছি। কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, নগরীর সব ওয়ার্ডে মাইকিং করা হচ্ছে। বিগত সময়ে ফুটপাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা চাঁদা নিয়েছেন। এখন থেকে আর কাউকে চাঁদা দিতে হবে না।