সরকারি চাকরি পেতে স্থায়ী ঠিকানা ও ভূ-সম্পত্তি বাধ্যবাধকতা নেই

প্রকাশিত: ১০:৫৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১০, ২০২১

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা পরিবারের ভূ-সম্পত্তি থাকার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এমনকি বাধ্যবাধকতা নেই স্থায়ী ঠিকানারও। কেবল বাংলাদেশের নাগরিক হলেই যে কেউ প্রজাতন্ত্রে নিয়োগ লাভের অধিকারী হবেন।

দেশের সংবিধানসহ বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বরিশালের হিজলা উপজেলার কলেজছাত্রী আসপিয়া ইসলাম পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য সাত স্তরে যাচাই-বাছাই, শারীরিক যোগ্যতা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা এবং দুই দফা মেডিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও সংশ্লিষ্ট এলাকায় জমি না থাকায় তাকে চাকরি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ বিভাগ। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তার পরিবারের জন্য জমি ও তাকে চাকরি দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। আলোচিত এই ইস্যুর সূত্র ধরে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেতে ভূ-সম্পত্তি বা স্থায়ী ঠিকানা থাকা না থাকার প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে দেশের প্রচলিত আইন, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি ও আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তারা জানিয়েছেন, চাকরিতে নিয়োগের সঙ্গে ভূ-সম্পত্তি বা স্থায়ী ঠিকানার কোনও সম্পর্ক নেই। দেশের নাগরিক হলেই যে কেউ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের আইনগত অধিকার অর্জন করবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার কারণে বিগত দিনে প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য সংবিধানের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা দফতরের বিধি অনুসরণ করা হতো। তবে সরকার ২০১৮ সালে ‘সরকারি চাকরি আইন’ প্রণয়ন করেছে। ওই আইনটি ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়ে আসছে।

সংবিধানের ২১, ২৯, ১৩৩ ও ১৩৬ অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে প্রণীত ওই আইনে প্রজাতন্ত্রে নিয়োগের বিধানাবলি যুক্ত রয়েছে।

আইনের ৭ ধারায় সরকারের কর্মবিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিধানের সঙ্গে ‘বাংলাদেশের নাগরিক নয় এমন কোনও ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করা যাবে না’ বিধানটি যুক্ত রয়েছে। আইনে নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে ভূ-সম্পত্তি থাকা বা স্থায়ী নাগরিক হওয়ার বিষয়ে কোনও কিছুই বলা নেই।

দেশে বলবৎ অন্য কোনও আইনে যা-ই থাক না কেন, সরকারি চাকরি আইনের বিধানাবলি প্রাধান্য পাবে বলেও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য কোনও বিশেষ শ্রেণির জন্য আপাতত বলবৎ অন্য কোনও আইন অথবা অনুরূপ আইনের অধীন প্রণীত বিধি, প্রবিধি বা আদেশে কোনও বিশেষ বিধান থাকলে, সেই বিশেষ বিধান প্রাধান্য পাবে বলেও এতে উল্লেখ রয়েছে।

সরকারি চাকরি আইনটি সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট কোনও চাকরি বা পদ, বিচার-কর্ম বিভাগ, প্রতিরক্ষা-কর্ম বিভাগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, স্ব-শাসিত সংস্থা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, কর্মসূচি বা অনুরূপ কোনও কার্যক্রমের আওতাধীন চাকরি এবং অ্যাপ্রেনটিস, চুক্তি বা অ্যাডহকভিত্তিক অথবা অন্য কোনও প্রকার অস্থায়ী, সাময়িক বা খণ্ডকালীন চাকরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের ডিআইজি (গণমাধ্যম) মো. হায়দার আলী খান বলেন, ‘বিষয়টি কেবল পুলিশের জন্য নয়। এটা সরকারি চাকরি বিধিতে আছে। আর বিধিটি হলো—কোনও জায়গার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। আর স্থায়ী বাসিন্দা বা ঠিকানা বলতে কোথাও খুঁজলে যেন আপনাকে পাওয়া যায়। স্থায়ী ঠিকানা বলতে আপনার কোথাও স্থাবর সম্পত্তি আছে। কিন্তু অনেকেরই এটা নেই। যাদের নেই তাদের বিষয় কী হবে তা সুস্পষ্টভাবে চাকরির বিধিমালায় থাকা দরকার। কেবল পুলিশ নয়, অন্যান্য বিভাগে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা আছে।’

বরিশালে আসপিয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আর যে প্রসঙ্গটি এসেছে অবশ্যই সেটা ভেবে দেখা দরকার। হয়তো অনেকের বাড়িঘর নেই। বা বিক্রি করে কোনও একটি স্থানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন, তার ক্ষেত্রে কী হবে। ফলে এই বিষয়ে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ হায়দার আলী খান আরও বলেন, ‘এটা পুলিশের আলাদা কোনও বিষয় নয়। কোনও কোনও চাকরিতে শর্ত থাকে যে, প্রার্থীকে বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক হতে হবে। দেখা যায়, স্থায়ী নাগরিক হলেও অনেকেরই হয়তো কোনও ভূ-সম্পত্তি নেই। সেক্ষেত্রে সমাধান কী হওয়া উচিত তার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বলেন, ‘চাকরিতে নিয়োগের জন্য প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হতে হবে। ভূ-সম্পত্তি থাকতে হবে এমন কোনও বিধান নেই।’

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘দেশের সংবিধান ও চাকরি সংক্রান্ত আইনে বলা আছে, নাগরিক নন—এমন কোনও ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কারো ভূ-সম্পত্তি না থাকলে দেশের নাগরিক হতে পারবে না, এমন কোনও বিধান সংবিধান বা আইনে নেই। ফলে ভূ-সম্পত্তি না থাকলে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে না—এরকম হতে পারে না। এটা হলে তা সংবিধানে কর্মে নিয়োগের যে অধিকার নাগরিকদের দেওয়া হয়েছে, তার পরিপন্থী হবে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমার জানা মতে, পুলিশে এরকম একটি বিধান ছিল। জেলা কোটার বিষয়ে যেমন- বাপ-দাদার জমি কোথায় সেগুলো তারা দেখে থাকে। এটা তাদের প্রচলিত নিয়ম ছিল, সেটা হয়তো তারা অনুসরণ করছে।’

অতীতে এরকম ঘটনার অবতারণা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা আগেই নির্দেশনা দিয়েছিলাম। কিন্তু কেন যে এটা আবারও তারা করলো, তা আমি জানি না। তারা হয়তো এটা খেয়াল করেনি। এটা কেন হয়েছে সেটা সব দেখে ব্যবস্থা নেবো।’

আসপিয়ার প্রসঙ্গ টেনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বরিশালের যে ঘটনাটি আমি জেনেছি, খুবই হৃদয় বিদারক। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন।’

প্রসঙ্গত, ভূ-সম্পত্তি না থাকার কারণে যোগ্য প্রার্থী হয়েও পুলিশের চাকরি পাননি, অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে একই কারণে চা শ্রমিকের পিতা-মাতার সম্পত্তি না থাকায় দুই জনের চাকরি হয়নি। ওই সময় বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হরে তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের একটি নীতিমালা আছে—চাকরির ক্ষেত্রে ভূ-সম্পত্তি থাকার বিষয়ে। এটি অনেক জায়গায় সমস্যা তৈরি করছে। এটা সংশোধনের বিষয়ে আমি উদ্যোগ নেবো।’