সর্বজনীন পেনশন: তিনদিনে ৪০ হাজার আবেদন, ২ কোটি টাকা জমা
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
সেলিনা আক্তার:
প্রবাস স্কিম, প্রগতি স্কিম, সুরক্ষা স্কিম এবং সমতা স্কিম- এ চার স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ স্কিম উদ্বোধনের পরই সর্বসাধারণের আবেদনের কার্যক্রম শুরু হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর প্রথম তিনদিনেই প্রায় ৪০ হাজার আবেদনকারী অনলাইনের মাধ্যমে নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার আবেদনকারী চাঁদা পরিশোধ করে আবেদনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ব্যক্তিদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই কোটি টাকার বেশি।
গোপালগঞ্জ, রংপুর, বাগেরহাট, রাঙ্গামাটি, সিলেট, পাবনা, ময়মনসিংহ ও বরগুনা এই আট জেলা এবং জেদ্দা, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর বৈদেশিক মিশনে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেন প্রধামন্ত্রী। উদ্বোধনের পর প্রথমদিনই অনলাইনের মাধ্যমে প্রায় আট হাজার আবেদনকারী সর্বজনীন পেনশনের জন্য নিবন্ধন করেন। তাদের মধ্যে এক হাজার ৭০০ জন চাঁদা পরিশোধ করে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
পেনশন স্কিম উদ্বোধনের পরের দুদিন গত শুক্র ও শনিবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। এ দুদিনে আরও ৩০ হাজারের বেশি মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে দুই হাজার ৫০০ জনের বেশি চাঁদা পরিশোধ করে পুরো আবেদন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছেন।
তথ্যানুযায়ী, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর প্রথম তিনদিনে নিবন্ধন করেছেন ৩৯ হাজার ৯৫৭ জন। তাদের মধ্যে চাঁদা পরিশোধ করেছেন চার হাজার ৩৯০ জন। পুরো আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ব্যক্তিদের পরিশোধিত মোট চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ১৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম তিনদিনেই প্রায় ৪০ হাজার আবেদন পড়েছে। শুরুতেই মানুষের এত সাড়া পাওয়া যাবে প্রত্যাশা করিনি।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এর জন্য যে পরিমাণ জনবল দরকার, তা নিয়োগ দেওয়া এখনো সম্ভব হয়নি। মানুষ যেভাবে সাড়া দিচ্ছে, তাতে দ্রুতই জনবল বাড়াতে হবে। অন্যথায় এর সুষ্ঠু তদারকি কঠিন হয়ে পড়বে।
যোগাযোগ করা হলে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে শুরুতে খুব ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম তিনদিনে অর্থাৎ শনিবার পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৯৫৭ জন নিবন্ধন করেছেন এবং চাঁদা জমা দিয়েছেন চার হাজার ৩৯০ জন। তিনদিনে মোট চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ১৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
সর্বস্তরের জনগণকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী) সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর বিষয়ে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে তিনি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ কর্তৃক ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ পাস করা হয়।
দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বর্তমানে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর হলেও ভবিষ্যতে তা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে জনমিতিক লভ্যাংশের আওতায় আছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ কর্মক্ষম। গড় আয়ু এবং একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে ভবিষ্যতে নির্ভরশীলতার হার বাড়তে পারে। এ কারণে একটি টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ লক্ষ্যেই সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর উদ্যোগ নেয়।
জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে মোট ছয়টি স্কিম থাকবে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ‘প্রবাস’, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী/প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য ‘সুরক্ষা’ এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের (বার্ষিক অনূর্ধ্ব ৬০ হাজার টাকা আয়সীমা) মানুষের জন্য অংশ প্রদায়ক ‘সমতা’ স্কিম এ চার ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে।
এরমধ্যে সমতা স্কিমে ব্যক্তির দেওয়া চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ দেবে সরকার। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনার বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে সুবিধামত সময়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সী একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা দেওয়া সাপেক্ষে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে সুবিধাভোগী ব্যক্তি মারা গেলে পেনশনারের নমিনি ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত পেনশন পাবেন।
চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু জমানো অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করতে পারবেন। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত পাওয়ার যোগ্য হবেন এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে।
সর্বজনীন পেনশনে আবেদন প্রক্রিয়া
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের জন্য একটি ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে। আগ্রহীরা িি.িঁঢ়বহংরড়হ.মড়া.নফ -এ ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন। ওয়েবসাইটে ঢুকে ‘পেনশনার রেজিস্ট্রেশন’ অপশনে ক্লিক করতে হবে। এরপর একটি প্রত্যয়ন পাতা আসবে। যেখানে লেখা থাকবে ‘এই মর্মে প্রত্যয়ন করছি যে আমি সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নই। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বহির্ভূত কোনো ধরনের সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে পেনশন সুবিধা গ্রহণ করি না। আমি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কোনো ধরনের ভাতা গ্রহণ করি না।’
এই প্রত্যয়ন পাতার নিচে ‘আমি সম্মত আছি’ লেখা একটি অপশন রাখা হয়েছে, সেখানে ক্লিক করলেই ধাপটি শেষ হবে। পরের ধাপে নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। সেখানে আবেদনকারীকে প্রথমে ‘স্কিম’ নির্বাচন করতে হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে ১০, ১৩ বা ১৭ সংখ্যার এনআইডি নম্বর, জন্মতারিখ, মোবাইল নম্বর, ই-মেইলের তথ্য দেওয়ার অপশন থাকবে। এ পেজের শেষ অংশে থাকবে ‘ক্যাপচা প্রদান করুন’। সঠিকভাবে ক্যাপচা দেওয়ার পর আবেদনকারীর মোবাইল ফোন নম্বর ও ই-মেইলে একটি ওটিপি যাবে। ওই ওটিপি ফরমে ব্যবহার করে পরের ধাপে যেতে হবে।
সেই ধাপটিতে আবেদনকারীর ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হবে। তবে আগের ধাপে দেওয়া এনআইডি অনুযায়ী এ ধাপে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবেদনকারীর এনআইডি নম্বর, ছবি, বাংলা ও ইংরেজি নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা দেখাবে। এখানে আবেদনকারীর বার্ষিক আয়ের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে এবং নিজের পেশা, বিভাগ, জেলা ও উপজেলার নাম নির্বাচন করতে হবে।
এই ধাপ শেষে ‘স্কিম তথ্য’ নামের আরেকটি পেজ আসবে। সেখানে মাসিক চাঁদার পরিমাণ ও চাঁদা পরিশোধের সময় বেছে নিতে হবে। সেখানে চাঁদা পরিশোধের জন্য মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক তিনটি অপশন থাকবে। এরপর দিতে হবে ব্যাংক তথ্য। এই ধাপে আবেদনকারীকে ব্যাংক হিসাবের নাম ও নম্বর, হিসাবের ধরন (সঞ্চয়ী অথবা চলতি), ব্যাংকের নাম ও শাখার নাম উল্লেখ করতে হবে।
এরপর যে পেজটি আসবে সেখানে নমিনির তথ্য দিতে হবে। নমিনির জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও জন্মতারিখ উল্লেখ করতে হবে। আবেদনকারী চাইলে একাধিক নমিনি রাখতে পারবেন। এই পেজে নমিনির মোবাইল ফোন নম্বর ও নমিনির সঙ্গে আবেদনকারীর সম্পর্ক উল্লেখ করতে হবে।
তারপর আবেদনকারীর জন্য আসবে নিবন্ধনের শেষ ধাপ। ‘সম্পূর্ণ ফরম’ নামের এ পেজটিতে আবেদনকারীকে ব্যক্তিগত তথ্য, স্কিম, ব্যাংকের তথ্য ও নমিনির তথ্য দেখানো হবে। সেখানে কোনো ভুল চোখে পড়লে এই পেজে তা সংশোধন করা যাবে। কোনো ভুল না থাকলে আবেদনকারীর সম্মতি মোতাবেক নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। অনলাইনে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড অথবা ব্যাংকের মাধ্যমে নির্ধারিত চাঁদার টাকা পরিশোধ করলে চূড়ান্তভাবে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।