সহিংসতায় বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন সংখ্যালঘুরা’

প্রকাশিত: ২:০৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ 

নির্বাচনের পর বাড়িঘরে আগুন দেওয়াসহ হামলার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আক্রান্ত সংখ্যালঘুরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এখনো কোনো কোনো স্থানে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কোথাও কোথাও প্রশাসন পদক্ষেপ নিলেও তাতে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এ অবস্থা চলতে পারে না। সংগঠনটি সারা দেশে নির্বাচন-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক হামলা অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানায়।

গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করায় এবং পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান নেতারা। মানববন্ধনে তারা বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, পিরোজপুর, মাদারীপুর, কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। নির্বাচনে ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ধর্মের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। যার পরিণতিতে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে।

সাংবাদিক বাসুদেব ধরের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে আরো বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, নিমচন্দ্র ভৌমিক, জয়ন্ত সেন দীপু, মিলন কান্তি দত্ত, মনীন্দ্র কুমার নাথ, তাপস কুমার পাল, পূরবী মজুমদার, রমেন মণ্ডল, শ্যামল রায়, কিশোর রঞ্জন মণ্ডল, বিপ্লব দে, ব্রজ গোপাল দেবনাথ, প্রাণোতোষ আচার্য্য শিবু, তাপস কুণ্ডু, গোপাল সরকার, কিশোর কুমার বসু রায় চৌধুরী পিন্টু, দিপালী চক্রবর্তী, বিনয় ঘোষ বিটু, শ্যামলী মুখার্জী, গিরিধারী সাহা, পরিমল ভৌমিক প্রমুখ।

এর আগে ভোটের দিন কুমিল্লার দাউদকান্দি পৌর সদরের বেগম আমেনা সুলতান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঈগল প্রতীকের সমর্থকরা পিপলু সাহা ও রঞ্জন সাহা নামের দুই জনকে কুপিয়ে আহত করেন। অভিযোগ, তারা নৌকা প্রতীকের সমর্থক। একই দিন ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের সমর্থক সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালান নৌকার সমর্থকরা। এতে মাঝিপাড়ায় ১৫ জন আহত হন। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলীতে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের হাতে আক্রান্ত হন সুরেশ চৌধুরী ও পঙ্কজ চন্দ। ভোটের পরদিন রাঙ্গামাটির কাউখালীর দুর্গম এলাকায় তিন আওয়ামী লীগ সমর্থক অপহূত হন। তারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। একই দিন গাইবান্ধা-৫ আসনে নৌকার সমর্থকরা কুলিপট্টি গ্রামে চার হিন্দু বাড়িতে হামলা চালান। তারা শিবু রায়ের বাড়ি থেকে বিদেশি প্রজাতির ৫ লাখ টাকার আটটি ছাগল নিয়ে যান। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বীর কন্যা ফারজানা রাব্বীর সমর্থক বলে জানা যায়। ৯ জানুয়ারি সাতক্ষীরা দেবহাট্টা ও সিরাজগঞ্জেও সংখ্যালঘুদের বাড়িতে লুটপাট ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার কাপালির বাজার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাজেশ রায়ের পিতা ভোগীরথ চন্দ্র রায় তাদের দোকানে নৌকার ক্যাম্প করতে দিয়েছিলেন। ভোটের দিন রাতে স্থানীয় ভাইস চেয়ারম্যান মশিউর রহমান মৃধার নেতৃত্বে তার ভাইপো সিফাত মৃধা তার দলবল নিয়ে ঐ দোকান ভাঙচুর করে। পরের দিন দুপুরে রাজেশ রায় বাজারে গেলে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তার ওপর হামলা করা হয়। তার হাঁটু ও চোখ প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

এদিকে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা-নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে সদ্যবিজয়ী বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুন নাহার ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মোংলা উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা কেশব লাল মণ্ডল এ অভিযোগ তোলেন। এ সময় নির্যাতন বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ভোট গণনা শেষ হতেই সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হামলা চালায়। বসতঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকান ভাঙচুর করে। ঘেরের মাছ লুট করে নিয়ে যায়। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না বাড়ির শিশু ও বৃদ্ধ নারীরা।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের দাবি, নির্বাচনের আগের রাতে লালমনিরহাট উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের যুবদলের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে স্থানীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে জেলেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই বলে হুমকি দেন যে ‘ভোটকেন্দ্রে গেলে জাল ও নৌকা দুইই যাবে। ভোটকেন্দ্রে গেলে এলাকা ছাড়তে হবে। এটা আমাদের নেতার নির্দেশ।’

ঐক্য পরিষদের দাবি অনুযায়ী, ৭ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও-১ আসনে তেনাই তোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ফেরার পথে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের হামলায় রোশনি রায় ও জয়দেব বর্মণ নামের দুই জন আহত হন।

ঐক্য ফোরামের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করলে তারা বিএনপি-জামায়াতের হাতে মার খান। আবার নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন করলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা তাদের ওপর চড়াও হন। এ অবস্থায় তারা কোথায় যাবেন?

কাউখালী (পিরোজপুর) সংবাদদাতা জানান, নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতার প্রতিবাদে পিরোজপুরের কাউখালীতে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন উপজেলা কমিটি। গতকাল বিকালে দেশব্যাপী পূজা উদ্যাপন কমিটির কর্মসূচির অংশ হিসেবে কাউখালী শ্রী শ্রী মদন মোহন জিউর আখড়াবাড়ীর সামনের সড়কে এই মানববন্ধন হয়। কর্মসূচিতে উপজেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির নেতারা ছাড়াও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।

মানববন্ধনে কাউখালী উপজেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ অলোক কর্মকার বলেন, দেশব্যাপী নির্বাচনের আগে ও পরে যে সহিংসতা হয়েছে তা কোনো মতেই কাম্য নয়। সঠিক বিচারের মাধ্যমে সহিংসতাকারীদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি। আরো বক্তব্য দেন পূজা উদ্যাপন কমিটির উপদেষ্টা কিরন হালদার, সাংগঠনিক সম্পাদক মানিক কর, প্রচার সম্পাদক সুজিত সাহা, কাউখালী ইউনিয়ন শাখার সভাপতি সজল কর্মকার প্রমুখ।

খুলনা অফিস জানায়, নির্বাচন পূর্বাপর সহিংস পরিস্থিতির প্রতিবাদে খুলনায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে পূজা উদ্যাপন পরিষদ খুলনা মহানগর ও জেলা শাখা। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণপদ দাস। বক্তারা বলেন, নির্বাচনের পূর্বে, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর ও হুমকি-ধমকির ঘটনা ঘটছে। যার শিকার হয়েছে খুলনা-৪ আসনের সংখ্যালঘুরা। এছাড়াও খুলনা-৫ আসন ও বাগেরহাটের রামপাল মোংলাতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অবিলম্বে এসব সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

মহানগর পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত কুমার কুণ্ডুর পরিচালনায় মানববন্ধনে খুলনা জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিমান সাহা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি বীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক গোপাল চন্দ্র সাহা, রতন কুমার নাথ, তিলোক গোস্বামী, বিশ্বজিত্ দে মিঠু, রবার্ট নিক্সন ঘোষ, সুশান্ত ব্যানার্জী, উজ্জ্বল ব্যানার্জী, ভবেশ সাহা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।