
সাইফুল ইসলাম:
দুই মাসে ৩০০-এর বেশি পারিবারিক বিরোধে খুন
নারী-শিশু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের ঘটনা ২৮৭০টি
নৈতিক অবক্ষয় পর্যায়ে :ড. তৌহিদুল হক
দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সামাজিক অপরাধ। অনৈতিক সম্পর্ক, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহের জের, জমি নিয়ে বিরোধ এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে সামাজিক অপরাধ ঘটছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মূল কারণ—আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা। আইন প্রয়োগের জায়গাটি অনেক দুর্বল। এই মুহূর্তে নীতিনৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের যে চরম অবক্ষয় ঘটেছে, সেটা রোধ করতে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। আর সামাজিক অন্যান্য আয়োজন বা ব্যবস্থাগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। এছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে হলে আইনের ওপর শতভাগ নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সামাজিক অপরাধ কেন বেড়ে গেছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. মো. তৌহিদুল হক এসব কথা বলেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে
সারা দেশে ঘটে যাওয়া সামাজিক অপরাধগুলোর পরিসংখ্যান পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধের ডাটাবেজ অনুযায়ী বলা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৮৭০টি। এদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০টি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটেছে ১ হাজার ৪৩০টি। চলতি মার্চ মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। সারা দেশে নারী বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৫টি। এর মধ্যে ধর্ষণের পর চার জনকে হত্যা করা হয়েছে। এক জন ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিন জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুই জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এমএসএফ এর প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে সব চেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বেশি। এছাড়া পরিবারিক সহিংসতা ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতো একই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে, যা ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তা দৃশ্যমান হয়নি। ফলে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ঘটেছে, যা জাতীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
পারিবারিক হত্যার শিকার
পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধের মাসিক ডাটাবেজ অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রয়ারি মাসে সারা দেশে ৫৯৪ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অর্ধেকই খুনের ঘটনা ঘটেছে সামাজিক অপরাধকে কেন্দ্র করে। সামাজিক ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহের কারণে অবলীলায় খুন হচ্ছে মানুষ। আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড। বাবা-মায়ের হাতে সন্তান হত্যার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি সন্তানের হাতে জন্মদাতা বাবা-মায়ের প্রাণহানিও ঘটছে। পরকীয়ার কারণে স্বামীর হাতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন হওয়ার ঘটনাও কম নয়। এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা করছে। জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে হত্যার ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ঘটনাই মামুলি বা তুচ্ছ কোনো কারণে। একটি ঘটনার নৃশংসতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটিকে। এসব কেবল আইনশৃঙ্খলার অবনতির দৃষ্টান্তই নয়, সামাজিক অসুস্থতারও লক্ষণ।
জমি নিয়ে বিরোধে খুন
সামাজিক অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে তার বেশির ভাগই অর্থসম্পদকে কেন্দ্র করে হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগি হতো না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। জমিকে কেন্দ্র করে এখন সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অর্থ-সম্পদ ও টাকা-পয়সার প্রতি মানুষের মোহ বাড়ছে। আর এসব কারণে সামাজিক অপরাধের মতো ঘটনাও ঘটছে।
গত ৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের মাতারগাঁও গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের গুলিতে নইমুল নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। গত ১ মার্চ ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বন্দেখালী গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিবেশী সুফি শেখকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। গত ১২ মার্চ নড়াইলের কালিয়ায় আকরাম শেখ (৪০) নামের এক প্রবাসফেরত ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সৌদিপ্রবাসী আকরাম শেখ মাসখানেক আগে বাড়ি আসেন। জমি ও স্থানীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আকরামের বাবা হেকমতের সঙ্গে একই গ্রামের আনসার জমাদ্দারের দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। ইফতারের পর আকরাম শেখ স্থানীয় একটি দোকানে গেলে আনসার জমাদ্দারের লোকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে।
পরকীয়ার জেরে খুন
পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, সামাজিক যাগাযোগ মাধ্যম মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ পরকীয়াসহ অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। হয়ে উঠছেন প্রাতিশোধপরায়ণ। গত ১৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পরকীয়ার জের ধরে স্বামীর হাতে স্ত্রী শারমীন আক্তার (২৪) এবং তার দুই শিশু সন্তান রওজা (৫) ও নওরিন (৩) হত্যার শিকার হয়। গত ১২ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড থানাধীন বালুর মাঠ এলাকায় পরকীয়ার জেরে বন্ধুর হাতে মোহাম্মদ আইয়ুব নবী (২৫) নামে এক যুবক খুন হন।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক অপরাধপ্রবণতা রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক প্রতিরোধও দরকার। এই ক্ষেত্রে সামাজিক অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতার কারণ অনুসন্ধান এবং তা দূরীকরণে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। দরকার পারিবারিক, সামাজিক ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধের চর্চা। সুস্থ মানস গঠনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সবাইকে আরো মনোযোগী হতে হবে।