সারা দেশে ডাল-পালা মেলছে প্রতারকচক্র

প্রকাশিত: ১০:৩৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২৪

সাইফুল ইসলাম:

# প্রতারকদের টার্গেটে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
# অপতৎপরতা রোধে সারা দেশে পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ নির্দেশনা
# প্রতারণা ঠেকাতে সচেতনতার তাগিদ

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র। এ চক্রের সদস্যরা নানা কৌশলে নিরীহ জনগণকে ফাঁদে ফেলে প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এরা কখনো নিজেদের সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পুলিশ-সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন গ্রæপে বিভক্ত হয়ে সারা দেশে অবাধ বিচরণ করছে। মাঝে মধ্যেই এরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলিয়ে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও পুরনো এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। এদের কবলে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক পরিবার। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতারণা ঠেকাতে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। পুলিশ-র‌্যাব বলছে, সারা দেশে ১৪২টি গ্রæপ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতারণার কাজে তৎপর রয়েছে। প্রতারকদের দমনে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তবে জনগণ সচেতন না হলে পুলিশের একার পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন। প্রতারকচক্রের অপতৎপরতা রোধে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ প্রশাসন থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। আজ শনিবার (২০ জানুয়ারি) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিস্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে যে হারে শিক্ষিত বাড়ছে, সে হারে কর্মক্ষেত্র বাড়ছে না। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে পড়ালেখা শেষ হলেও জুটছে না কাঙ্খিত চাকরি। শিক্ষিত বেকাররা নিজ জেলায় ব্যর্থ হয়ে চাকরির সন্ধানে ভিড় করছেন রাজধানীতে। এ সুযোগে এক শ্রেণীর প্রতারক চাকরি নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসে আছে। এই ফাঁদে পড়ে অনেকেই চাকরি পাওয়ার আসায় প্রতারিত হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে গড়ে উঠছে প্রতারণার অনেক প্রতিষ্ঠান। অল্প বিনিয়োগে ব্যবসা, চাকরি লাভ থেকে শুরু করে নানাভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে। চাকরি দেওয়ার নামে জামানত নিয়ে সটকে পড়ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে পরিচয় দেওয়া প্রতারকরা। তারা অনলাইন প্লাটফর্মে এবং পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বেকার তরুণদের আকৃষ্ট করে নানা কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দিচ্ছে। তথ্য-প্রমাণের অভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে প্রতারকচক্রকে চিহ্নিত করা সহজেই সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ, র‍্যাব, দুদকের ভয় দেখিয়ে অনেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। চাকরিতে নিয়োগ-বদলি, মামলা থেকে অব্যাহতিসহ নানা কাজের কথা বলে প্রতারণা চলছে সারা দেশে। প্রতারণা হচ্ছে প্রেম-বিয়ের নামেও। আর এসব ঘটনায় উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। পুলিশ ও র‍্যাব সারা দেশে এ রকম ১৪২টি প্রতারক গ্রæপের সন্ধান পেয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে ঢাকায় তৈয়বুদ্দিন গ্রæপ, মেহেদী হাসান গ্রæপ, সোহেল গ্রæপ, রিয়াজ ফকির গ্রæপ, আরিফুজ্জামান গ্রæপ, সেলিম গ্রæপ, আকতার হোসেন গ্রæপ, সুমন গ্রæপ, সজল হাওলাদার গ্রæপ, নান্নু মিয়া গ্রæপ ও সোহেল রানা গ্রæপ, নাটোরের সোহাগ গ্রæপ, সরকার গ্রæপ, শাজাহান হোসেন গ্রæপ, আব্দুল জলিল গ্রæপ, ইয়ারত আলী গ্রæপ, ফারুক হোসেন গ্রæপ, মাহবুব সরকার, সোহেল রানা গ্রæপ, ফারুক হোসেন গ্রæপ, সফিকুল ইসলাম গ্রæপ ও তহিদুল, ইসলাম গ্রæপ বেশি বেপরোয়া। তারা বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা জানান, প্রতারকরা বেশি টার্গেট করছে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, চাকরিজীবী ও বেকার যুবকদের। আদালতপাড়া, সচিবালয়, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও হাসপাতাল ঘিরে সক্রিয় এসব চক্রের বেশিরভাগ সদস্য। চাকরিতে নিয়োগ, বদলি, জামিন দেওয়া, আসামির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থাসহ নানা কথা বলে তারা মোটা অংকের অর্থ আদায় করছে।
হাজারীবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নূর মোহাম্মদ নিউজ পোস্টকে বলেন, প্রতারক জুটন মিয়া নিজেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগিনা ও ডিএমপি কমিশনারের ছোট ভাই পরিচয় দিয়ে এবং ছবি প্রদর্শন করে আ. রাজ্জাক রাজন নামের এক ব্যক্তির নিকট থেকে বিভিন্ন সময় প্রতারণা করে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় জুটনের অবস্থান সনাক্ত করে গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
এদিকে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে নবনিযুক্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তি ফেসবুকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরিচয় ব্যবহার করে সমাজের বিভিন্ন সম্মানিত ব্যক্তির মেসেঞ্জার গ্রæপে অসাধু/অসৎ উদ্দেশ্যে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। বিষয়টি নজরে এলে প্রতারণা এড়াতে গত ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। ওই বার্তায় বলা হয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের কোনো ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট বা পেজ নেই।
এদিকে ডিএমপির রমনা বিভাগের ডিসি (অ্যাডিশনাল ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন নিউজ পোস্টকে বলেন, গত ১৩ জানুয়ারি ডাক্তার দেখানোর কথা বলে প্রতারণার ফাঁদ পেতে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালের সামনে থেকে পুলিশের পোশাক ব্যবহার করে প্রতারক বাবুল ওরফে হারুন নরসিংদীর হেলেনা বেগম ও বান্ধবী রীনার কাছ থেকে চিকিৎসার ২৭ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় গত ১৫ জানুয়ারি বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকা থেকে পোশাক পরিহিত ভুয়া পুলিশ প্রতারক হারুনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে অনলাইন গেমে পরিচয়ের পর এক তরুণীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার অভিযোগে করা মামলায় গত ১৮ ডিসেম্বর গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর এলাকা থেকে প্রতারক তাসিউর রহমান শিশিরকে গ্রেফতার করা হয় বলে নিউজ পোস্টকে জানিয়েছেন ডিএমপির ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের টিম ইনচার্জ অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আশরাফউল্লাহ।
এসব বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া সেলের ডিসি মো. ফারুক হোসেন নিউজ পোস্টকে বলেন, প্রতারকদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলামান। এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেলেই জড়িতদের গ্রেফতার করছে পুলিশ। প্রতারক নির্মূল করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভভ নয়। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। কোনো লোভনীয় ফাঁদে পা বাড়ানোর আগে তা যাচাই-বাছাই করা জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের সময় কোনো সাক্ষ্য রাখা হয় না। প্রতারণার শিকার হলে বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমানের অভাবে প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর নিউজ পোস্টকে বলেন, প্রতারকরা প্রতিনিয়তই নানা কৌশল অবলম্বন করে নিরীহ জনসাধারণকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জনগণকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। যদি কারও কাছে সন্দেহভাজন এমন কাউকে মনে হয়, তাহলে ‘৯৯৯’ অথবা নিকটস্থ থানা পুলিশকে অবহিত করার আহŸান জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তিনি আরও বলেন, প্রতারকদের অপতৎপরতা রোধে সারা দেশের বিভিন্ন রেঞ্জের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতারকদের তালিকা করে অনুসন্ধান চালিয়ে গ্রেফতারের নির্দেশনাও দেওয়া রয়েছে।