
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
বাঁধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের নারীরা দৃষ্টান্ত। এ নিয়ে তর্কবিতর্কের সুযোগ নেই। কালের বিবর্তনে ধ্রুব তারার মতো সত্য সংসারজীবনে নারী যতটা যতেœ সুঁইসুতোর বুননে তার কৃতিত্বে ফুটিয়ে তুলতে পারে শান্ত নদীর বয়ে চলা সুর আবার সেই সুঁই দিয়েই নিখুঁত ভাবে খুটে বের করে আনতে পারে চলার পথের অজাচিত কাঁটা।
কেউ স্বীকার করুক কিংবা নাই করুক ইতিহাস ঘেটে একথা বলতে আজ আর দ্বিধা হয়না আমাদের প্রগতিশীল-সভ্য সমাজে নারীরা পরমুখাপেক্ষী না হয়ে দেশ ও জাতির সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে সগৌরবে।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দিয়ে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিনতা যুদ্ধ এমমকী দেশ স্বাধীনের পর বাংলার মাটিতে একের পর এক ঘটে যাওয়াা আন্দোলনে নারীদের ছিল অকুতোভয় অংশগ্রহন এক গৌরবময় অধ্যায়েরই বাহক।
আজ নারী দিবসকে সামনে রেখে নারী জাগরণের এ ক্ষনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীরা আবারও গৌরবগাঁথার সাক্ষর রেখেছে সেটি
চব্বিশের জুলাই বিপ্লব।
এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবস, ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য হলো ‘’ অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন’
মার্চ মাসের ৮ তারিখ বিশ্বজুড়ে উদ্যাপিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। যে উদ্দশ্যে লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারীর প্রতি সম্মান ও সমানাধিকারের বার্তায় এ দিবসটি পালন করা হয় তার যথাযত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে।
অথচ দিন গড়িয়ে মাস পেরিয়ে নতুন স্বাধীনতার সুর্যতলে দাঁড়িয়ে আজ কী নির্মম ভাবে অট্টহাসিতে নুয়ে পরছে বাংলাদেশ। কারণ আজও আন্দোলনের কাতারে পুরুষের পাশে নারীর কণ্ঠস্বর এতটা উচ্চে উঠলেও নারীর কিন্তু সমমর্যাদায় পিছিয়েই রয়েছে। জুলাই বিপ্লবে নারীদের বীরত্বগাঁথা বিশ্বের কাছে রোলমডেলে পরিনত হওয়ার পরেও নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি।
জুলাই-আগস্টে সংঘঠিত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান ফ্যসিবাদের দমনের মধ্য দিয়ে আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছে। এতে নতুন রাজনৈতিক পরিবেশের বিচরন ঘটেছে যা পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে নারী-পুরুষ সর্বত্র মর্যাদাপূর্ণ নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা দানা বেঁধেছে। জুলাই বিপ্লবে পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো একজন আবু সাঈদ হয়ে ওঠেন ২০২৪ সালের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রতীক।
এক আবু সাইদ যেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব লিঙ্গ-জাতি-ধর্মের মানুষকে দায়বদ্ধ করেছেন।
সাঈদের মতো শহীদের পেছনে থাকা হাজারো মায়েরা ছিলেন এই আন্দোলনের সৈনিক। সব বাধা-ভয় পেরিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের রূপ দিয়েছেন। অন্যায়, অবিচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সমর্থন-সংহতি জানায় সাধারণ জনগণ।
‘২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নারীর বিশাল ভূমিকা ছিল। নারী শিক্ষার্থীরা সামনে এগিয়ে গিয়ে আগলে রেখেছেন পুরুষ শিক্ষার্থীদের। অভ্যুত্থানের পর এই নারীদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি; কিন্তু কেন। এ নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্নতা আছে, এখনই সময় নারীর এ ব্যাপারগুলো গুরুত্ব দেওয়ার।
বিদ্যমান সংবিধানে দেখা যায় কেবল নারীর অধিকারের কথা বলা হয়েছে জনজীবনেই অথচ পারিবারিক অধিকার, সম্পত্তির অধিকার রয়ে গেছে সেগুলো আজও যার যার ধর্মের অধীনে।
তাই রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে নারীর অধিকার যুক্ত করা করতে সংবিধানে নারী অধিকার নিয়ে যে দুর্বলতা ও বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করতে সংস্কার আবশ্যক।
শুরু থেকে জুলাই বিপ্লবে সম্মুখভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। পরে দেশের যে কোন জায়গায় এই আন্দোলন চলছে নারীরা ছিল ছায়ার মতো।
অথচ আজ যখন নারীর চাকরির নিয়োগে নারীদের বৈষম্যের শিকার হতে দেখা যায় সেটি দুঃখজনক। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় নারীকে নিয়োগ দওয়া উচিত। বৈষম্যের তালিকায় প্রতিবারের মতো এবার নারীর অবদান বিলীন হতে দেওয়া যাবে না।’ এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে সংস্কার ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে নারীদের যুক্ততার বিষয়ে প্রশ্ন তুলছে বিভিন্ন অধিকার সংগঠন ও নারীনেত্রীরা।
বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় যত আইন আছে— তার বাস্তবায়নের জায়গায় বেশ কিছু বৈষম্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে আসছেন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দৃশ্যমান পরিসরে নারীর প্রতি অবমাননাকর বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীতে ওভারব্রিজের ওপর নারীকে পেটানো, কক্সবাজারে নারীকে কান ধরে ওঠবস করানো, বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান যৌনকর্মীদের মারধরসহ বেশ কয়েকটি নেতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।
নারীর উত্তরাধিকার বিষয়ক জটিলতা দীর্ঘদিনে সমাধান করা সম্ভব হয়নি। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের মধ্য দিয়ে বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয় সমাধানের যে আকাঙ্ক্ষা, সেখান থেকেই এই কমিশনের অপেক্ষায় আছেন নারীনেত্রীরা। কিন্তু এক মাস পার হয়ে গেলেও এখনও এ বিষয়ে কোনও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।
১৭ অক্টোবর নারী অধিকার বিষয়ক কমিশনসহ ৪টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অর্ন্তর্বতী সরকার। নারী অধিকার বিষয়ক কমিশনের প্রধান করা হয় বিশিষ্ট নারীনেত্রী শিরিন হককে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল—কমিশনের মেয়াদ প্রজ্ঞাপন প্রকাশের দিন থেকে ছয় মাস। কমিশন প্রধান এবং এর সদস্যরা পূর্ণকালীন হিসেবে কমিশনে কাজ করবেন। এ সময়ে তারা অন্য কাজ থেকে বিরত থাকবেন। তাদের কাজের জন্য অফিস এবং সাচিবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তারা প্রতিবেদন দেবেন প্রধান উপদেষ্টাকে।
কেন নারীদের বিষয়ে এসেই বারবার থমকে যেতে দেখা যায়— জানতে চাইলে ‘উই ক্যান জোট’র সমন্বয়ক জিনাত আরা হক এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আন্দোলনে অনেক স্টেক ছিল, শুরুতেই সবাই যার যার দাবি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের দাবিতে নারীর অধিকারের বিষয় আসেনি। নারী প্রশ্ন কী বদলাবো, কীভাবে বদলাবো সেই আলাপ হয়নি। নারীর যুক্ততা হুট করে বসিয়ে দেওয়ার বিষয় না। ধারাবাহিক আলাপের মধ্য দিয়ে প্রতি জায়গায় নারীর যুক্ততা নিশ্চিত করতে হয়।
আন্দোলনকালে এই আলাপগুলো হওয়ার কথা, সেটা হয়নি। সব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত না হয়, তবে সে এই সিস্টেম থেকে ছিটকে পড়বে। তবে শুধু নারীকে বিভিন্ন জায়গায় অন্তর্ভুক্ত করে সমাধান হবে না। উন্নয়নটা সবার এটা যদি না ভাবতে পারি, তাহলে সবার চাহিদাটা জানতে হবে। সেটা পূরণ করতে হবে।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীদের ভূমিকার কথা একবার চিন্তা করুন। সন্তান, সম্পদের সুরক্ষা তো বটেই, দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় নারীর অবদান সারা বিশ্বে স্বীকৃত। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে ছাত্রীরা ভালো করছে। শুধু তা-ই নয়, চাকরি ও সেবা খাতেও তাদের এগিয়ে যাওয়া লক্ষণীয়। খেলাধুলায় পরপর সাফল্য এসেছে মেয়েদের হাত ধরে।
আমাদের সংবিধান পাঁচ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সমানাধিকার নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতগুলো বছর পরও নারীদের প্রতি বৈষম্য ঘুচেছে কতটুক?
গত বছর ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার কিশোরী ও নারীরা আছে পুষ্টি–সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ইউনিসেফ বলে, এ দেশের মেয়েরা অপুষ্টির দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছে।
যে নারীরা পোশাক খাতে বিপ্লবের সূচনা করেছেন, গবেষণা বলছে অঞ্চলভেদে দেশে নারী পোশাকশ্রমিকদের মজুরিতে ৫১ থেকে ৬০ শতাংশ বৈষম্য রয়েছে। সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার তো দূর কি বাত, এই সমাজ এখনো সম্পদ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে নারীকে মানতে পারে না। হাসপাতালগুলোয় নারীদের আসনসংখ্যা এখনো পুরুষের সমান নয়। প্রশাসনে নারীদের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বড় প্রকল্পগুলো পরিচালনার দায়িত্ব তারা পান না বললেই চলে।
সতীর্থ পুরুষ খেলোয়াড়দের চেয়ে নারীরা বেতন কম পান। অথচ তাদের সিংহভাগ সমাজের পশ্চাৎপদ পরিবারগুলো থেকে হাজারো বাধা ডিঙিয়ে খেলতে আসেন।
এখনো নারীদের জন্য নিরাপদ শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই, ট্রেনে-বাসে নারী ও কন্যাশিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়। বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুল-কলেজ বা কর্মস্থলে যেতে তাদের জন্য গণপরিবহন একটা আতঙ্কের নাম।
আজও বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে অষ্টম এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনসূত্রে কিছুদিন আগেই সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকারের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শুধু আফগানিস্তানের ওপরে।
গবেষণা, সমীক্ষা আর সূচকে দেশে নারীর প্রতি বৈষম্যের যে ছবি, তা বেদনাদায়ক।
নারীর সম-অধিকার প্রাত্যহিক চাহিদা বলেই মনে করা হয়। এটি অবশ্যই নারীর জন্য জরুরি ইস্যু। তাই একটি দিন অর্থাৎ ৮ মার্চই নারীর প্রতি সমানুভূতি প্রদর্শন না করে, বছরের বাকি ৩৬৪ দিনও জেন্ডার সমতার কথা মাথায় রেখে কাজ করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। কারণ, নারীর জন্য বিনিয়োগ মানে দেশ ও জাতির জন্য বিনিয়োগ। নারীর উন্নয়নেই নিহিত দেশের আপামর জনগণের উন্নয়ন। নারী যেহেতু মা, তাই একটি পরিবারে, সমাজে ও দেশে নারীর ভালো থাকার সঙ্গে সুস্থ সন্তান ও সুস্থ জাতি গড়ে উঠবে।