সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন এলাকায় ট্রলারডুবির ঘটনায় ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ৭৬ জনকে। বাকিদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী। ওই ট্রলারে ১২০ জনের মতো রোহিঙ্গা ছিল বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা।
এ ঘটনায় টেকনাফ থানা পুলিশ তৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মানব পাচারকারী দালাল আইয়ুব, রফিক ও সাদ্দাম নামে তিন দালালকে আটক করেছে।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, পাঁচটা ছোট ছোট বোটে করে মোট ১৩৮ জন রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া রওনা করেছিল। পরে দালাল তাদেরকে একটি বোটে তুলে নেয় যেটি ভোরে ডুবে যায়। সকাল থেকে যে নিখোঁজ বোটের কথা বলা হচ্ছিল, তা মূলত ওই ছোট ছোট বোটগুলোরই একটা ছিল।
মঙ্গলবার ভোরে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপের কাছে সমুদ্রে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, হতাহতদের সবাই রোহিঙ্গা নাগরিক। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন তারা।
সেন্টমার্টিন কোস্ট গার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. নাঈম উল হক বলেন, ট্রলারডুবিতে মৃত ও জীবিত সবাই রোহিঙ্গা। তারা সবাই উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করে আসছিলেন। ওই এলাকার কিছু রোহিঙ্গা ও স্থানীয় দালালের হাত ধরে সোমবার রাতে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য একটি ট্রলারে করে সাগর পথে রওনা দেন তারা। রাতের কোনো এক সময় ছেঁড়া দ্বীপের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনার শিকার হয় ট্রলারটি। পরে খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকালে সাগর থেকে হতাহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করা হয়।
লে. নাঈম আরও বলেন, উদ্ধার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা বেশ কিছু দালালের বিষয়ে জানতে পরেছি। তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। জীবিতদের সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ড কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবার দেয়া হয়েছে।
উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে এক তরুণী জানান, তাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি বিনা খরচে বিদেশে নিয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য বলে আসছিল। তাদের কথামত পিতা-মাতা রাজি হওয়ার পর একাধিকবার যাওয়ার তারিখ পড়ে। সর্বশেষ সোমবার সন্ধ্যার আগে তাকে ক্যাম্প থেকে বের করে পাশবর্তী একটি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে তার মতো আরও অনেকেই বিদেশ যাওয়ার জন্য ওই ঘরে অবস্থান করছে। পরে রাত ১১টার দিকে ওই ঘর থেকে বের করে দালালচক্র তাদের ট্রালারে তুলে দেয়।
এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা নেতা ছৈয়দ উল্লাহ জানান, দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে বেশ কিছু দালাল সক্রিয় রয়েছে। বাইরের কিছু দালালের সহযোগিতায় তারা রোহিঙ্গাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের চেষ্টা চালায়।
সূত্র জানায়, সোমবার রাতে টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবিরের কয়েকটি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় দালালরা মিলে ক্যাম্পের সুন্দরী তরুণীদের বিদেশে নিয়ে বিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ক্যাম্প থেকে বের করে। পরে দালালের পরিকল্পনা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপকে টেকনাফের বাহারছড়া দিয়ে ট্রলারে তুলা হয়। পাশাপাশি পৃথক আরেকটি গ্রুপকে তুলা হয় উখিয়-টেকনাফের মাঝামাঝি সমুদ্র তীরবর্তী স্থান থেকে।
টেকনাফের স্থানীয় সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন ভুলু জানান, ট্রলার ডুবির ঘটনায় মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৬ জনকে।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. এবিএম মাসুদ হোসেন বিপিএম বলেন, প্রতি বছর শীতকাল আসলেই মানবপাচার বেড়ে যায়। কারণ দালালরা এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে মানবপাচার শুরু করে। তবে সম্প্রতি সময়ে যারা এই কাজে পা দিয়েছে তারা সিংহভাগেই রোহিঙ্গা। মূলত স্থানীয় ও কিছু রোহিঙ্গা দালালরা নানা প্রলোভন দিয়ে রোহিঙ্গাদের পাচার করছে।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, মঙ্গলবার পাচারের সময় যেসব রোহিঙ্গা ট্রলার ডুবিতে মারা গেছে তাদেরকে টেকনাফের বাহারছড়া ও উখিয়া-টেকনাফের মাঝামাঝি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বোটে তুলা হয়েছিল। এই পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল ইতিমধ্যে তাদের তিন দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হল টেকনাফের বাহারছড়া আইয়ুব, রফিক ও সাদ্দাম।