ফরিদপুর প্রতিনিধি:
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশি এক পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দুইজন। গতকাল শনিবার (৫ আগস্ট) মক্কা থেকে ওমরাহ শেষে দাম্মামে ফেরার পথে আল কাসিম এলাকায় এ দুর্ঘটনা। হতাহতদের বাড়ি ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলী মহল্লায়। এ ঘটনায় তাদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।নিহতরা হলেন- ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলী মহল্লার মোবাররক শেখ (৪৬), তার ছেলে তানজিল আবদুল্লাহ মাহি (১৭) ও ছোট মেয়ে মাহিয়া (১৩)। আহতরা হলেন- মোবাররকের স্ত্রী আফরোজা বেগম সিমা (৩৬) ও মেয়ে মিথিলা আক্তার মীম (২০)। তারা সবাই সৌদি আরবের দাম্মামে থাকতেন।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মোবাররক বিগত প্রায় ২৫ বছর ধরে সৌদি আরবের দাম্মাম শহরে থাকেন। ওই শহরে তিনি একটি ওয়ার্কশপের ব্যবসা করতেন। সেখানে স্ত্রী আফরোজা বেগম সিমা, দুই মেয়ে মিথিলা আক্তার মীম ও মাহিয়া এবং একমাত্র ছেলে তানজিল আব্দুল্লাহকে নিয়ে সপরিবারে বসবাস করতেন তিনি। সৌদি আরবেই জন্ম ছোট মেয়ে ও ছেলের। বড় মেয়ে মিথিলা কানাডায় শিক্ষা বৃত্তি পেয়েছেন। তিনি সেখানে যাবেন। সব প্রস্তুতি শেষ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে গত বুধবার (২ আগস্ট) দাম্মাম থেকে মক্কায় যান ওমরা হজ পালন করতে মোবাররক। ল্যান্ড ক্রুজারের একটি গাড়ি নিজেই চালিয়ে রওনা দেন। ফেরার পথে ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। গতকাল শনিবার সৌদি আরবের সময় ভোর সাড়ে ৪টার দিকে দাম্মামে ফেরার পথে আল কাসিম নামক স্থানে পেছনের একটি গাড়ি ওভার টেক করার সময় মোবাররকের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে। সড়কের ওপর উল্টে যায় মোবাররকের গাড়ি। এতে মোবাররক, তার ছোট মেয়ে মাহিয়া ও ছেলে তানজিল মারা যান। আহত হন স্ত্রী আফরোজা ও বড় মেয়ে মিথিলা। আহতরা এখন সৌদি আরবের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মোবাররক ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলী মহল্লার বাসিন্দা ধানসিঁড়ি বাড়ির মালিক শেখ মোহাম্মদ আলী (৭৫) ও আলেয়া বেগমের (৬৫) সন্তান । পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় এবং ভাইদের মধ্যে বড়।
শেখ মোহাম্মদ আলী পেশায় একজন কৃষক। তার আদি নিবাস ছিল ফরিদপুরের চরভদ্রাসন এলাকার গাজীরটেক ইউনিয়নের হোসেনপুর এলাকায়। ৩০ বছর আগে পদ্মা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে বসতঘর ও বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরে এই পরিবারটি ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলী মহল্লায় সাড়ে ১০ শতাংশ জমি কিনে বসবাস শুরু করেন। মোবাররক সৌদি আরবে যাওয়ার পর ভাগ্য অনুকূলে আসে পরিবারটির। ওই জমিতে একটি বাড়ি করেছেন মোহাম্মদ আলী। নাম দিয়েছেন ‘ধান সিঁড়ি’। বাড়িটির দোতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তিন তলা নির্মাণাধীন। ওই বাড়িতে গিয়ে দোতলায় উঠে প্রথমে দেখা হয় মা আলেয়া বেগম ও বাবা মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। ছেলে ও দুই নাতি-নাতনিকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান আলেয়া বেগম। কথা বলতে পারছেন না তিনি। মোহাম্মদ আলী মাঝে মাঝে কথা বলছেন, আবার কাঁদছেন, কান্না থামিয়ে আবার কথা বলছেন।
মোহাম্মদ আলী জানান, তার স্ত্রী আলেয়ার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছিল। চেন্নাই থেকে চিকিৎসা করিয়ে এক সপ্তাহ আগে ফিরেছেন। তিনি বলেন, আমার কী সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি কী অন্যায় করেছিলাম যে ছেলে ও নাতি-নাতনির মৃত্যুর খবর শুনতে হলো। আমার বাবা (ছেলে) ও তার দুই সন্তানের মরদেহ দেশে এনে কবর দিতে চাই। এ ব্যাপারে আমি সরকারের সাহায্য চাই। পাশের ঘরে অনবরত কেঁদে যাচ্ছিল নিহত মোবাররকের ছোট বোন রিক্তা (৩১)। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল ভাই-বোন ও স্বজনরা।
কান্নাজড়িত কন্ঠে রিক্তা বলেন, আমার ভাই তার আদরের দুই সন্তানদের আর দেখা পাব না। এ যে কী কষ্ট তা আমি বলতে পারছি না। সহ্য করতে পারছি না। একটা সোনার সংসার ভাইঙা চুইড়া শেষ হইয়া গেল। মোবাররক সর্বশেষ দুই বছর আগে ফরিদপুরের বাড়িতে এসেছিলেন। তার স্ত্রী আফরোজা এসেছিলেন গত আট-নয় মাস আগে। দেড় মাস আগে এসে ঘুরে গেছেন তাদের বড় মেয়ে মিথিলা।