লাইফস্টাইল ডেস্ক:
একবার নয়, আমি হিট স্ট্রোকের কবলে দুই দুইবার পড়েছিলাম। কোনো বড় ক্ষতি ছাড়াই টিকে গেছি। তবে হিট স্ট্রোকে গতকালকেই অনেকগুলো মৃত্যু দেখে বুঝলাম, কত বড় বাঁচা বেঁচে গেছি আমি। অবশ্য মারা না গেলেও দুইবারই আমি বিপদে পড়তাম যদি পাশে কেউ না থাকতো। প্রথম হিট স্ট্রোক করি পানিতে দাঁড়ানো অবস্থায়। পানিতে পড়ে যাবার মুহূর্তে আমাকে ধরে ফেলেন খালাতো বড় ভাই। হাঁটু পরিমাণ পানি ছিল। একা থাকলে পানিতে ডুবেই অনায়াসে মারা যেতে পারতাম।
দ্বিতীয় স্ট্রোক হয় হাসপাতালের সিঁড়িতে। এবারও পড়ে যাবার ঢলে পড়ার সময়ে ঢাল হয়ে দাঁড়ান আমার মেজ ভাই। সিঁড়িতে পড়ে গেলে কিছু না কিছু ইনজুরি তো হতোই। এই দুই ঘটনা থেকে দুইটা জিনিস আমার জানানোর দরকার মনে হলো। প্রথমত, হিট স্ট্রোকের অভিজ্ঞতার অংশটুকু বলি। দুইবারের কোনোবারই কিন্তু আমি খুব একটা বুঝিনি যে কী বিপদ সামনে আসতেছে। প্রচুর গরম লাগা দিয়ে শুরু। গরম লাগলে আমাদের শরীর পুড়ে, কিন্তু জ্বরের মতো শরীর গরম হয় না। শরীরের একটা ন্যাচারাল কুলিং সিস্টেম আছে। ঘামের মাধ্যমে শরীর অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়। হিট স্ট্রোকের আগে এই মেকানিজম ফেইল করে। সুতরাং শরীর গরম হবে।
সমস্যা হলো, এই গরম তো জ্বর না। জ্বরের মতো পরিচিত কোনো অনুভূতি হয় না। গরমে নাজেহাল অবস্থা থাকে, খেয়াল হয় না শরীরের তাপমাত্রা আর স্বাভাবিক নেই। গায়ে হাত দিয়ে অনুভব করার কথা সেভাবে মাথায় থাকে না। কিন্তু শরীর গরম হতেই থাকে। ১০০ ডিগ্রি থেকে ১০২, ১০২ থেকে ১০৪, এমনকি ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটেও চলে যেতে পারে। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটে অতি অল্প সময়ের মধ্যে।
হিট স্ট্রোকের মুহূর্তে মূলত দুইটা অনুভূতি হয়। একটা হলো, কেমন গা গুলানো বমি বমি ভাব হবে। আমার যেটা করেছিলাম অধিকাংশ ভিক্টিম তাই করবে হয়তো। তখন আশেপাশে তাকিয়ে বমি ভাব লাগার কারণ খুঁজবে। কিংবা ভাববে, নিশ্চয়ই খাবারে গন্ডগোল ছিল। দ্বিতীয় অনুভূতি হচ্ছে, খারাপ লাগা। এই খারাপ লাগার ব্যাখা নাই। একটু অস্বস্তি, কিছুটা অশান্তি। কনফিউশন। মনে হবে, আচ্ছা আমার এমন লাগছে কেন? আমি কি একটু বসব? আরে থাক, এমনিই এমন লাগছে ঠিক হয়ে যাবে। আমার কি বেশিই খারাপ লাগছে? কাউকে বলব? না থাক, আর সামান্য হাঁটি বা কাজ করি, পরে রেস্ট নেব নে। এমন অনেক তো হয়। ঠিক হবে, ঠিক হবে।
কিন্তু এটা ঠিক হবে না।
আপনি আরো কনফিউজড হবেন৷ কথা জড়িয়ে যাবে। শরীরের নিয়ন্ত্রণ ও কথা বলার ক্ষমতা মুহূর্তের মধ্যে হারাবেন। তারপর পা টাও নাড়ানোর সুযোগ পাবেন না; পড়ে যাবেন। এই যে লক্ষণ বা অনুভূতির কথা বললাম, এসব ঘটতে খুব বেশি সময় লাগে না। হাতে গোনা কয়েক মিনিট। এই সময়টাই আপনাকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। অর্থাৎ আপনারা যারা এই গরমে বাইরে বের হবেন, কাজ করবেন তারা এই লক্ষণ ও অনুভূতির মধ্য দিয়ে গেলে প্রথম সেকেন্ডেই সতর্ক হতে হবে।
গায়ে হাত দিয়ে তাপ দেখুন। বেশি মনে হলেই হল্ট। কোনো কনফিউশনে পড়া যাবে না। হাঁটলে হাঁটা থামিয়ে ছায়ায় বসে পড়ুন। গাছ না থাকলে পাশের কোনো দোকান বা বাসার গ্যারেজে ঢুকুন। গায়ের তাপ যদি বেশি দেখেন, সাথে সাথে পানি খান বা কারো কাছে পানি চান। এই সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে একটু পরেই আপনি চিন্তার নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। সিভিয়ার কনফিউশন হবে। তখন আপনার ভাগ্য অন্যের হাতে থাকবে।
আর হ্যাঁ, এসব কেবল বাইরেই ঘটতে পারে এমন না। নিজের বাসায়ও ঘটার সম্ভাবনা আছে। বিশেষত বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দীর্ঘসময় থাকলে ঝুঁকি বাড়তে পারে। আমার অভিজ্ঞতার দ্বিতীয় অংশটা হচ্ছে, অন্যের হেল্প। আমি দুইবারই আমার আপন মানুষ দ্বারা তড়িৎ সেবা পেয়েছি। দুইজনই আমার রক্তের আপন, তারা একটা সেকেন্ড দেরি না করে আমাকে হেল্প করেছেন। এমন রোগী হ্যান্ডেলের অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। শুধু ইনটিউশন দিয়ে তারা আমাকে ছায়ায় নিয়েছে, বাতাস করেছে, গায়ের কাপড় খুলেছে, গায়ে ঠান্ডা পানি দিয়েছে।
হিট স্ট্রোক ও কিছু কথা
লাইফস্টাইল
হিট স্ট্রোক ও কিছু কথা
জয়নাল আবেদীন
২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪৪
একবার নয়, আমি হিট স্ট্রোকের কবলে দুই দুইবার পড়েছিলাম। কোনো বড় ক্ষতি ছাড়াই টিকে গেছি। তবে হিট স্ট্রোকে গতকালকেই অনেকগুলো মৃত্যু দেখে বুঝলাম, কত বড় বাঁচা বেঁচে গেছি আমি। অবশ্য মারা না গেলেও দুইবারই আমি বিপদে পড়তাম যদি পাশে কেউ না থাকতো। প্রথম হিট স্ট্রোক করি পানিতে দাঁড়ানো অবস্থায়। পানিতে পড়ে যাবার মুহূর্তে আমাকে ধরে ফেলেন খালাতো বড় ভাই। হাঁটু পরিমাণ পানি ছিল। একা থাকলে পানিতে ডুবেই অনায়াসে মারা যেতে পারতাম।
বিজ্ঞাপন
দ্বিতীয় স্ট্রোক হয় হাসপাতালের সিঁড়িতে। এবারও পড়ে যাবার ঢলে পড়ার সময়ে ঢাল হয়ে দাঁড়ান আমার মেজ ভাই। সিঁড়িতে পড়ে গেলে কিছু না কিছু ইনজুরি তো হতোই। এই দুই ঘটনা থেকে দুইটা জিনিস আমার জানানোর দরকার মনে হলো। প্রথমত, হিট স্ট্রোকের অভিজ্ঞতার অংশটুকু বলি। দুইবারের কোনোবারই কিন্তু আমি খুব একটা বুঝিনি যে কী বিপদ সামনে আসতেছে। প্রচুর গরম লাগা দিয়ে শুরু। গরম লাগলে আমাদের শরীর পুড়ে, কিন্তু জ্বরের মতো শরীর গরম হয় না। শরীরের একটা ন্যাচারাল কুলিং সিস্টেম আছে। ঘামের মাধ্যমে শরীর অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়। হিট স্ট্রোকের আগে এই মেকানিজম ফেইল করে। সুতরাং শরীর গরম হবে।
সমস্যা হলো, এই গরম তো জ্বর না। জ্বরের মতো পরিচিত কোনো অনুভূতি হয় না। গরমে নাজেহাল অবস্থা থাকে, খেয়াল হয় না শরীরের তাপমাত্রা আর স্বাভাবিক নেই। গায়ে হাত দিয়ে অনুভব করার কথা সেভাবে মাথায় থাকে না। কিন্তু শরীর গরম হতেই থাকে। ১০০ ডিগ্রি থেকে ১০২, ১০২ থেকে ১০৪, এমনকি ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটেও চলে যেতে পারে। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটে অতি অল্প সময়ের মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
হিট স্ট্রোকের মুহূর্তে মূলত দুইটা অনুভূতি হয়। একটা হলো, কেমন গা গুলানো বমি বমি ভাব হবে। আমার যেটা করেছিলাম অধিকাংশ ভিক্টিম তাই করবে হয়তো। তখন আশেপাশে তাকিয়ে বমি ভাব লাগার কারণ খুঁজবে। কিংবা ভাববে, নিশ্চয়ই খাবারে গন্ডগোল ছিল। দ্বিতীয় অনুভূতি হচ্ছে, খারাপ লাগা। এই খারাপ লাগার ব্যাখা নাই। একটু অস্বস্তি, কিছুটা অশান্তি। কনফিউশন। মনে হবে, আচ্ছা আমার এমন লাগছে কেন? আমি কি একটু বসব? আরে থাক, এমনিই এমন লাগছে ঠিক হয়ে যাবে। আমার কি বেশিই খারাপ লাগছে? কাউকে বলব? না থাক, আর সামান্য হাঁটি বা কাজ করি, পরে রেস্ট নেব নে। এমন অনেক তো হয়। ঠিক হবে, ঠিক হবে।
কিন্তু এটা ঠিক হবে না।
আপনি আরো কনফিউজড হবেন৷ কথা জড়িয়ে যাবে। শরীরের নিয়ন্ত্রণ ও কথা বলার ক্ষমতা মুহূর্তের মধ্যে হারাবেন। তারপর পা টাও নাড়ানোর সুযোগ পাবেন না; পড়ে যাবেন। এই যে লক্ষণ বা অনুভূতির কথা বললাম, এসব ঘটতে খুব বেশি সময় লাগে না। হাতে গোনা কয়েক মিনিট। এই সময়টাই আপনাকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। অর্থাৎ আপনারা যারা এই গরমে বাইরে বের হবেন, কাজ করবেন তারা এই লক্ষণ ও অনুভূতির মধ্য দিয়ে গেলে প্রথম সেকেন্ডেই সতর্ক হতে হবে।
বিজ্ঞাপন
গায়ে হাত দিয়ে তাপ দেখুন। বেশি মনে হলেই হল্ট। কোনো কনফিউশনে পড়া যাবে না। হাঁটলে হাঁটা থামিয়ে ছায়ায় বসে পড়ুন। গাছ না থাকলে পাশের কোনো দোকান বা বাসার গ্যারেজে ঢুকুন। গায়ের তাপ যদি বেশি দেখেন, সাথে সাথে পানি খান বা কারো কাছে পানি চান। এই সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে একটু পরেই আপনি চিন্তার নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। সিভিয়ার কনফিউশন হবে। তখন আপনার ভাগ্য অন্যের হাতে থাকবে।
আর হ্যাঁ, এসব কেবল বাইরেই ঘটতে পারে এমন না। নিজের বাসায়ও ঘটার সম্ভাবনা আছে। বিশেষত বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দীর্ঘসময় থাকলে ঝুঁকি বাড়তে পারে। আমার অভিজ্ঞতার দ্বিতীয় অংশটা হচ্ছে, অন্যের হেল্প। আমি দুইবারই আমার আপন মানুষ দ্বারা তড়িৎ সেবা পেয়েছি। দুইজনই আমার রক্তের আপন, তারা একটা সেকেন্ড দেরি না করে আমাকে হেল্প করেছেন। এমন রোগী হ্যান্ডেলের অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। শুধু ইনটিউশন দিয়ে তারা আমাকে ছায়ায় নিয়েছে, বাতাস করেছে, গায়ের কাপড় খুলেছে, গায়ে ঠান্ডা পানি দিয়েছে।
এই যে একটা হিট ওয়েবের সময় যাচ্ছে, এটা লিটারেলি দুর্যোগের সময়। দুর্যোগে মানুষকে একে অন্যের আপন হতে হয়। কেউ যদি হিট স্ট্রোকের লক্ষণযুক্ত কোনো মানুষকে বসে পড়তে বা ঢলে পড়তে দেখেন, প্লিজ তাকে সাহায্য করবেন। শুরুতেই ছায়ায় নিয়ে যান। বাতাস করুন। গায়ে বাতাস লাগতে দিন। পুরুষ মানুষ হলে নির্দ্বিধায় উপরের জামা কাপড় খুলে নিন। ভিক্টিম মহিলা হলে সম্ভব যদি হয় আশেপাশের মহিলা কারোর হেল্প নেয়া যেতে পারে। হাতে পায়ে ও ঘাড়ে ঠান্ডা পানি বা বরফ দিয়ে ম্যাসেজ করুন৷ মনে রাখবেন, হিট স্ট্রোকের ক্ষতি কমানোর একটাই উপায়; যত দ্রুত সম্ভব শরীর ঠান্ডা করা। দেরি হলে ক্ষতির আশংকা বাড়বে। ব্রেইন ড্যামেজ হতে পারে, কিডনি ফেইল করতে পারে।
সবার জন্য সাধারণ কিছু পরামর্শ। সবাই জানেন, তাও মনে করিয়ে দেয়া-
১। অতি প্রয়োজন ছাড়া কেবল আড্ডাবাজির জন্য বাইরে বের না হওয়াই উত্তম।
২। বাইরে বের হলে সাথে যতটা সম্ভব পানি রাখা যায়, রাখা উচিত। একটু পরপর পানি খান।
৩। সাদা পাতলা ও সুতির কাপড় পরে বের হওয়া ভালো।
৪। ক্যাপ, ছাতা সাথে রাখুন।
৫। গরমের মধ্যে শরীরে যে কোনো অস্বাভাবিকতা টের পেলেই সবচেয়ে খারাপ জিনিসটাই আশংকা করুন এবং সেভাবে ব্যবস্থা নিন।
সর্বোপরি, দুর্যোগে সহনশীল ও মানবিক মনের পরিচয় দেবার বিকল্প নেই। আপনার অধিনস্তের সাথে সদয় ব্যবহার করুন। নিজের কাছে অতিরিক্ত পানি থাকলে আপনার রিকশাওয়ালাকে অফার করতে পারেন। যাদের সুযোগ আছে তারা নিজেদের বাসায় শ্রমজীবী মানুষের জন্য পানির ব্যবস্থা রাখুন প্লিজ। একটা দেশ, সমাজ টিকে থাকার ক্ষেত্রে শ্রমিক-দিনমজুরদের অস্তিত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। এই কটাদিন সম্ভব হলে পারিশ্রমিক দেবার ক্ষেত্রে একটু বিবেচনা করতে পারেন।
দুর্যোগ বেশিদিন থাকবে না। কিছু মানুষের জীবন নিয়ে হলেও এটা চলে যাবে। আমাদের মানবিক বোধের আবেদন চিরন্তন। মানবিক আচরণ ও পরস্পরকে সাহায্য ব্যতীত আমরা টিকে থাকতে পারব না। টিকলেও সেটাকে সুস্থভাবে টিকে থাকা বলা যাবে না।
সবাই সচেতন হোন। নিজের ও পরিবারের খেয়াল রাখুন। হিট স্ট্রোকে সার্ভাইভ করলেও এর অভিজ্ঞতা যে কতটা ভীতিকর এটা আমি জানি। আপনারা যেন অন্তত নিজের অবহেলায় এই অভিজ্ঞতা অর্জন না করেন, এই কামনা রইল। সকলের জন্য ভালোবাসা।