২ বছরেও শেষ হয়নি নির্মাণকাজ, বীর নিবাসে ওঠার আগেই ফাটল

প্রকাশিত: ৪:১১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৯, ২০২৪

জেলা প্রতিনিধি,নীলফামারীঃ

নীলফামারীর ডিমলায় দুই বছর ধরে ছাদ ঢালাই দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত আবাসস্থল ‘বীর নিবাস’-এর নির্মাণকাজ। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।এছাড়া কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভবনের নানা স্থানে ফাটল দেখা দেওয়ায় নিবাসে ওঠা নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন অনেকে। নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করায় অল্প দিনেই সরকারের দেওয়া উপহার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

এ উপজেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের বিশেষ সম্মাননা হিসেবে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে পাকা বাসস্থান দেওয়ার প্রকল্পের আওতায় ৩২টি বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু হয়। বীর নিবাস নামের একতলা এই বাড়িগুলোতে রয়েছে তিনটি শয়নকক্ষ, একটি বারান্দা ও শৌচাগার। প্রতিটি একতলা বাড়ি নির্মাণ করতে খরচ ধরা হয় ১৪ লাখ টাকা। নিয়োগ দেওয়া হয় কয়েকজন ঠিকাদারকে।

উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। দরপত্রে ২০২২ সালের জুন ও ২০২৩ সালের জুন মাসে ভবন হস্তান্তর করার কথা থাকলেও দেওয়া আর ছাদ ঢালাই দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে ঘরগুলো। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ করে রেখেছেন। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন উপকারভোগীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরাদ্দের অর্থ বৃদ্ধির আশায় ঠিকাদাররা বাড়ির নির্মাণকাজ ফেলে রেখেছে।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকার বীর নিবাস ঘুরে দেখা যায়, নির্ধারিত সময় শেষ হলেও ভবনের চারপাশে শুধু ইট আর সিমেন্ট দিয়ে দেয়াল তুলে ছাদ ঢালাই করে ফেলে রাখা হয়েছে। অনেক ভবনেই পলেস্তারা খসে পড়ছে। নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করায় দরজা খুলে গেছে। কোনো কোনো ভবনের ছাদ চুইয়ে পানি পড়ছে ঘরের ভেতরে। বেশিরভাগ পরিবারের পুরনো ঘর ভেঙে ফেলায় তাদের স্থান হয়েছে ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে কেউ আবার থাকছেন ভাড়া করা ঘরে।

উপকারভোগীরা জানান, এক বছরের বেশি সময় ধরে কাজ বন্ধ। ঘরের ছাদ ঢালাই দিয়ে ঠিকাদার লাপাত্তা। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। নিম্নমানের ইট, বালুসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার হচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-সন্তানরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাকা ভবন পেয়ে আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এটি নির্মাণ করতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে এখন চরম দুর্ভোগে আছি।উপজেলার শুটিবারি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত আব্দুল কাদেরের স্ত্রী জমিলা খাতুন প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে বীর নিবাসের ঘর বরাদ্দ পান। আড়াই বছর আগে ওই ঘরের নির্মাণকাজ শুরু করেন সাব ঠিকাদার টিটু। কাজের জন্য নিজের পুরাতন ঘর ভেঙে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন জমিলা।

তার ছেলে জুয়েল ইসলাম বলেন, আমাদের আর কোনো জায়গা না থাকায়, মাকে নিয়ে দুই বছরের বেশি সময় ধরে ভাড়া বাড়িতে আছি। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এই উপহারের ঘর আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কিন্তু শুরু থেকেই নির্মাণকাজে ধীরগতি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করছে ঠিকাদার। কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভবনের চারপাশে ফাটল দেখা দিয়েছে। পলেস্তারাও খসে পড়ছে। এ অবস্থায় ভবনে বসবাস করা নিয়ে চরম আতঙ্কে আছি।এ বিষয়ে সাব ঠিকাদার টিটুর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

দোহলপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুক্তা আক্তার বলেন, বীর নিবাস নির্মাণের জন্য দুই বছর আগে পুরাতন ঘর ভেঙে জায়গা খালি করি। এরপর থেকে আমরা একটি খুপড়ি ঘরে থাকি। এই গরমে বৃদ্ধ মাসহ পুরো পরিবার দুর্বিসহ জীবন যাপন করছি। কিন্তু দুই বছরেও ঠিকাদার কাজ শেষ করেনি। এদিকে ভবনের ছাদ চুইয়ে ঘরে পানি পড়ে। এই ঘর নির্মাণ শেষ হলেও এখানে কীভাবে থাকব কে জানে।

রুপাহারা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, ঘর বরাদ্দ পাওয়ার পর আমার আগের ঘরটির স্থানেই কাজ শুরু হয়েছে। এ জন্য দুই বছর ধরে রান্না ঘরেই থাকছি।গয়াবাড়ি ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎ চন্দ্র ব্যানার্জি জানান, তার ঘরের নির্মাণকাজ অর্ধেক করে দুই বছর ফেলে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন ফেলে রাখায় ভবনের ইটগুলো নষ্ট হয়ে খসে পড়ছে। মরিচা পড়ে লোহার গ্রিল নষ্ট হচ্ছে। একই চিত্র উপজেলার অন্তত ২৫টি বীর নিবাসে।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার জন্য ঘরের যে নকশা করা হয়েছে তা সন্তোষজনক নয়। ভবনে বিম নেই। ছাদের কোনো কার্নিশ রাখা হয়নি। ফলে বর্ষায় বৃষ্টির পানি দেয়াল বেয়ে পড়ে ঘরে পানি প্রবেশ করতে পারে।

দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন সাব ঠিকাদার মাফিকুল ইসলাম বলেন, দুটি প্যাকেজে ১২টি বাড়ি নির্মাণকাজ আমি করছি। দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি ও ফান্ড না থাকায় আমরা কাজ শেষ করতে পারিনি। এছাড়া কাজের বরাদ্দে অর্থ বৃদ্ধির আশায় নির্মাণকাজে কিছুটা ধীরগতি হয়েছে। তবে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করে দেব। কাজের মানের বিষয়ে তিনি বলেন, দরপত্র অনুযায়ী কাজ হচ্ছে।এসব বিষয়ে উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মেজবাহুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ঘরগুলোর নির্মাণকাজ কোন অবস্থায় আছে সে বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন নীলফামারীর জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ।