২০ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৫ জনের যাবজ্জীবন হাইকোর্টে বহাল

আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা

প্রকাশিত: ৩:০১ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০২৫


নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

আলোচিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোববার এই রায় দেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন), জেল আপিল ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন।

মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামিরা হলেন– মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার, মেহেদী হাসান রবিন, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, মো. মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম তানভীর, হোসাইন মোহাম্মদ তোহা, মো. শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মুনতাসির আল জেমি, মো. শামসুল আরেফিন রাফাত, মো. মিজানুর রহমান, এস এম মাহমুদ সেতু, মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মুজতবা রাফিদ। তখন তিনজন পলাতক ছিলেন– মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মুজতবা রাফিদ।

আসামিদের মধ্যে মুনতাসির আল জেমি গত ৬ আগস্ট গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল ভেঙে পালিয়েছেন বলে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত– মুহতাসিম ফুয়াদ হোসেন, মো. আকাশ হোসেন, মুয়াজ আবু হুরায়রা, অমিত সাহা ও ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না। আসামিদের মধ্যে তিনজন মামলার শুরু থেকেই পলাতক। ওই তিন আসামি– তানিম, জিসান ও রাফিদ।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার প্রমুখ। আসামিপক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান, আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু প্রমুখ।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে ভবিষ্যতে যেন আর কোনো আবরারকে জীবন দিতে না হয়, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে র‍্যাগিংমুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, যাতে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করতে পারে।’
আবরার ফাহাদের ছোট ভাই বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ বলেন, ‘হাইকোর্ট থেকে এত বড় একটি রায় আসবে– এক বছর আগে এমনটি আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি এ সময় গত বছরের ৬ আগস্ট কারাগার থেকে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুনতাসির আল জেমির পালানোর প্রসঙ্গ তুলে হতাশা প্রকাশ করেন। আবরার ফাইয়াজ বলেন, ‘৫ আগস্টের পর অনেকে পালিয়েছে। কিন্তু এমন একজন আসামি, যিনি আবরার ফাহাদকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছয় মাস পরে কেন জানানো হলো– সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।’ যত দ্রুত সম্ভব রায় বাস্তবায়ন করে এটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপনের জন্য আদালতের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

আবরারের মা রোকেয়া খাতুন দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন। রায় ঘোষণার সময় ফাহাদের মা কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কে নিজ বাড়িতে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের একটাই চাওয়া, রায়টা যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর হয়। আমার মতো কোনো মায়ের সন্তানকে যেন অল্প বয়সে এমন নির্মমভাবে জীবন দিতে না হয়।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আবরারের মৃত্যু আমাদের কাছে পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে আছে। গোটা জাতির মূল্যবোধের শিকড়ে নাড়া দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে বার্তা গেল– আপনি যত শক্তিশালী হোন না কেন; আপনার পেছনে যত শক্তি থাকুক না কেন; সত্য এবং ন্যায়বিচার একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে।’ আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘নিম্ন আদালত যে ফাইন্ডিংস দিয়েছেন, এখানে ইন্টারফেয়ারের মতো কিছু নেই।’

এদিকে প্রত্যাশা অনুযায়ী ন্যায়বিচার পাননি বলে দাবি করেছেন ফাহাদ হত্যা মামলার আসামি মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম ও মেফতাউল ইসলাম জিওনের পক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। রায়ের সার্টিফায়েড কপি হাতে পাওয়ার পরই আপিল বিভাগে আপিল করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যাদের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলাম, তার মধ্যে মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলামের নাম এজাহারে ছিল না। তার বিরুদ্ধে যে চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সাজা দেওয়া হয়েছিল ট্রায়াল ট্রাইব্যুনালে, সেই চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্য, অর্থাৎ তাদের জবানবন্দিতে সেই বক্তব্যগুলো নেই। ট্রায়াল ট্রাইব্যুনাল অস্তিত্বহীন ডিপোজিশন ইনসার্ট করে রায় দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে একটিও ইনক্রিবিডিং এভিডেন্স নেই। এই কারণে আমি মনে করছি, ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছি। আশা করি, আপিল বিভাগ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।’

বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র আবরার থাকতেন শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। সেখান থেকে ডেকে নিয়ে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। রাত ৩টার দিকে হলের সিঁড়ির করিডোর থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ফেসবুকে ভারতবিরোধী স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন হয়। হত্যাকাণ্ডের পরদিন আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। একই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘আসামিরা পরস্পর যোগসাজশ করে ছাত্রশিবির কর্মী সন্দেহে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে।’ ওই মামলায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ের পরই সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা এবং রাষ্ট্রপক্ষে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়। গত অক্টোবরে এই মামলায় আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি শুরু হয়। পরে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় গতকাল হাইকোর্টও বহাল রাখেন।